মোবাইল ফোন যুদ্ধে কে জিতবে?

নকিয়া, স্যামসাং ও অ্যাপল
নকিয়া, স্যামসাং ও অ্যাপল

অ্যাপল, গুগল, মাইক্রোসফট। মোবাইল ফোন নিয়ে যুদ্ধ এখন এই তিন প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু জিতবে কে? ৭২০ কোটি মার্কিন ডলারে নকিয়া মোবাইল ফোনের ব্যবসা মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষ কিনে নেওয়ার ঘোষণা আসায় প্রযুক্তি বিশ্বে এখন আলোচিত প্রশ্ন এটি।

 মার্কিন প্রযুক্তিবিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে কম্পিউটারের বিক্রি কমে যাচ্ছে। পার্সোনাল কম্পিউটার থেকে হাতে থাকা যন্ত্রের (মোবাইল ডিভাইস) দিকে ঝুঁকে পড়েছে প্রযুক্তিবাজার। গুগুলের অ্যানড্র্রয়েড, অ্যাপলের আইওএস আর মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ—এই তিন প্ল্যাটফর্মের স্মার্টফোন বাজারে চলছে যুদ্ধ। স্যামসাং, অ্যাপল ও নকিয়া—এই তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিত্ব করছে তিনটি প্ল্যাটফর্মের। তবে বাজারে তুলনামূলক বিচারে ৭৯ শতাংশ অ্যানড্রয়েডের দখলে।  আর সেই বাজারে প্রতিযোগিতা করতেই এক ধাপ এগুলো শীর্ষ সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট করপোরেশন। মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ  অপারেটিং সিস্টেমনির্ভর স্মার্টফোন জনপ্রিয় করতে নকিয়া কিনে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এবার নতুন করে অ্যাপল ও গুগলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে মাইক্রোসফট।

২০১১ সাল থেকেই নকিয়া মাইক্রোসফটের অধীনে যাচ্ছে এমন গুঞ্জন ছিল। বর্তমানে মোবাইল ফোনের বাজারে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে মাইক্রোসফট নকিয়া কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নকিয়া মাইক্রোসফটের চুক্তির অধীনে উইন্ডোজনির্ভর স্মার্টফোন তৈরি করবে নকিয়া। নকিয়ার ডিভাইস ও সার্ভিস ইউনিটের জন্য ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার দিতে রাজি হয়েছে মাইক্রোসফট। পাশাপাশি নকিয়ার পেটেন্ট লাইসেন্স কিনতে খরচ করবে ২২০ কোটি মার্কিন ডলার। এদিকে, মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী স্টিভ বালমার আগামী বছর অবসরে যাচ্ছেন। স্টিভ বালমারের জায়গায় খোঁজা হচ্ছে নতুন প্রধান নির্বাহী। নকিয়া কিনে নেওয়ায় স্টিভেন ইলোপই হতে পারেন মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী। এর আগে মাইক্রোসফটে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল ইলোপের। চুক্তিতে ৩২ হাজার কর্মী মাইক্রোসফটে কাজ করবেন।

অ্যাপল দীর্ঘদিন ধরেই আইফোন নিয়ে বাজারের একটি অংশ দখলে রেখেছে। অ্যাপলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গত বছর গুগল কর্তৃপক্ষ মটোরোলা কিনে নিয়েছে। মটোরোলার নতুন স্মার্টফোন মটোএক্স বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে গুগল। অ্যাপল ও গুগলের সঙ্গে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজনির্ভর স্মার্টফোন দিয়ে কিছুতেই পেরে উঠছিল না নকিয়া। বাজারবিশ্লেষকেরা বিভিন্ন সময় মাইক্রোসফটকে নকিয়া কিনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। নকিয়া মাইক্রোসফটের অধীনে যাওয়ায় এবার শুরু হবে ত্রিমুখী যুদ্ধ।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সূক্ষ্ম এক রেখার ওপর হাঁটতে হচ্ছে মাইক্রোসফটকে। একদিকে লাখ লাখ উইন্ডোজ ব্যবহারকারীকে ধরে রাখা, অন্যদিকে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট কম্পিউটারের বাজারেও প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে তাদের। এতে করে লাভ হবে প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারকারীদের। একদিকে যেমন পণ্যের মান ভালো হবে, তেমনি দামের ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা বাড়বে।

ত্রিমুখী যুদ্ধ
মোবাইল ফোনের বাজারে এখন তিনটি পক্ষ দাঁড়াল—গুগল, অ্যাপল, মাইক্রোসফট। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে অভিজ্ঞ ও বাজারসচেতন কর্মকর্তা। সবাই নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা আর দুর্বলতা সম্পর্কেও পূর্ণ সচেতন। প্রযুক্তিবিশ্লেষকেরা ত্রিমুখী যুদ্ধে অ্যাপলের বড় অস্ত্র ভাবেন এর উদ্ভাবনী দক্ষতা এবং নতুন পণ্যের নকশাকে। নতুন আইফোনের জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকেন অ্যাপলের ভক্তরা। তবে বাজারবিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যাপলের দূরদর্শী নেতা স্টিভ জবস ২০১১ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে জৌলুশ হারাতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন সেই অ্যাপল আর নেই। বর্তমান প্রধান নির্বাহী টিম কুক ভালোভাবে প্রতিষ্ঠানটি সামলাতে পারলেও উদ্ভাবনী ক্ষমতা ক্ষয়ে এসেছে অ্যাপলের। অ্যানড্রয়েডের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে বাজারে দখল কমে গেছে আইফোনের। নতুন করে মোবাইল ফোনের বাজার নিয়ে ভাবতে হচ্ছে অ্যাপলকে। অ্যাপল কখনো মানের সঙ্গে আপস করে সস্তা ফোন আনবে না, এমন ভাবনাও বদলে ফেলেছেন অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী। মোবাইল ফোনের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এখন অ্যাপল নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তবে বাজার গবেষকদের মতে, অ্যাপলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তাদের আত্মতুষ্টি।

গুগলের বর্তমানে বড় সাফল্য হলো অ্যানড্র্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমকে জনপ্রিয় করতে পারা। গুগলের কথিত ‘এক্স ল্যাব’-এ সৃজনশীল পণ্য নিয়ে সব সময়ই প্রযুক্তিবিষয়ক সাইটগুলোতে নানা আলোচনা থাকে। সার্চে নতুন ফিচার থেকে শুরু করে, গুগল গ্লাস, রোবো ট্যাক্সির মতো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে গুগল। তবে গুগলের ভাবনার বড় অংশজুড়ে এখন মোবাইল ফোন। মটোরোলা কিনে নেওয়ার পর এ বছরই নতুন করে স্মার্টফোনের পরিকল্পনা নতুন করে সাজিয়েছে গুগল কর্তৃপক্ষ। মটোরোলা থেকে প্রথমবারের মতো ঘোষণা দেওয়া মটোএক্স স্মার্টফোনে সেই সৃজনশীলতা দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গুগলের প্রধান লক্ষ্য ছিল অ্যাপলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা। বাজারবিশ্লেষকদের মতে, গুগল সে লক্ষ্যে সাফল্য পেয়েছে। তবে অ্যাপলের সঙ্গে যুদ্ধে মাইক্রোসফটকেও তাতিয়ে দিয়েছে গুগল। অ্যাপলের জনপ্রিয়তায় ভাগ বসানো গুগলের অপারেটিং সিস্টেমের দুর্বলতা হলো ম্যালওয়্যার।

পণ্য কেনার সময় দামের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের মান বড় হয়ে দেখা দেয়। উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম বিশ্বের অগণিত মানুষের পছন্দ। মাইক্রোসফটের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা হলো, এর যে বিশাল পসরা সাজানো আছে, তা একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত বা এর ইকোসিস্টেম। বাজারবিশ্লেষকেরা মাইক্রোসফটের সমালোচনা করে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির প্রধান স্টিভ বালমার, মোবাইল ফোনের বাজারে ইকোসিস্টেম পরিপূর্ণ কাজে লাগাতে পারেননি বলেই অ্যাপল ও গুগল আজ মাইক্রোসফটকে ছাড়িয়ে গেছে। নতুন করে প্রতিষ্ঠানটি গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে যাচ্ছে। তবে দুর্বলতা হলো, মাইক্রোসফটের উদ্ভাবনী নেতৃত্বের অভাব।

ত্রিমুখী যুদ্ধে অ্যাপল-স্যামসাং-নকিয়া
স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বজুড়ে এখন অ্যাপল, স্যামসাং ও নকিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলছে। তবে স্মার্টফোনের বাজারে বিভিন্ন মাপের পণ্য থাকায় ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় স্যামসাং বাজার দখল করতে পেরেছে। অ্যাপল শুধু আইফোন দিয়ে একটি বিশেষ শ্রেণীর ক্রেতা ও আগ্রহী গোষ্ঠী তৈরি করতে পেরেছে। নকিয়া সিমবিয়ান প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে উইন্ডোজে এসে বিশাল সমস্যার মুখে পড়েছে। তবে লুমিয়া নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এবার মাইক্রোসফটের অধীনে যাওয়ায় ফিনল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি যুদ্ধে নতুন রসদ পাবে। আগামী এক দশকে স্মার্টফোনের বাজারে কে শাসন করবে, তা নির্ভর করছে স্মার্টফোননির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনী দক্ষতার ওপর। যুদ্ধ চলছে এ ত্রয়ীর।

নকিয়া কেন অ্যানড্রয়েডে যায়নি
নকিয়া-ভক্তদের একটি প্রশ্ন সব সময় শোনা যায়, নকিয়া কেন অ্যানড্রয়েডে যায়নি। নকিয়ার প্রধান নির্বাহী স্টিফেন ইলোপ বলেন, একটি নির্দিষ্ট হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের অ্যানড্রয়েডপ্রীতিতে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, ওই প্রতিষ্ঠানটি অ্যানড্রয়েডে প্রতিনিধিত্ব করবে। কিন্তু অ্যানড্রয়েড প্ল্যাটফর্মে নকিয়া যেতে চাইলে তা দেরি হয়ে যাবে, ফলে বাজারে প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব হবে না। এ সিদ্ধান্তটি তখন নিয়ে খুশি ছিলেন তিনি।

২০১১ সালে অ্যাপলের আইওএস ও গুগলের অ্যানড্রয়েডের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে সিমবিয়ান প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করেন নকিয়ার প্রধান নির্বাহী। তখন তিনি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে উইন্ডোজকে বেছে নেন। তবে লোকসানে ডুবতে বসা নকিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মাইক্রোসফটকে বেছে নিলেও গত দুই বছরে নকিয়ার ভাগ্যে বড় পরিবর্তনের হাওয়া লাগেনি।

ত্রিমুখী লড়াইয়ে কে জিতবে
টাইম অনলাইনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, মোবাইল ফোন ইকোসিস্টেমের লড়াইয়ে যেকোনো একটি প্ল্যাটফর্মকে জিততে হবে। অর্থাত্, গুগল জিতলে মাইক্রোসফট ও অ্যাপলকে হারতে হবে। তবে বাজারবিশ্লেষকেরা বলছেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভোগ্যপণ্যের বাজার অনেক বড়। এখানে একাধিক ইকোসিস্টেম জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে গুরুত্ব থাকবে ব্র্যান্ড ভ্যালুর দিকটি। অর্থাত্, একটি পণ্যের জনপ্রিয়তা দিয়ে নয়, পণ্যের ব্র্যান্ড ঠিকঠাক থাকলে তা গ্রাহকদের কাছে দীর্ঘদিন আবেদন রাখবে। নকিয়া এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।