মানববর্জ্য থেকে উপকারী সার

মানববর্জ্য থেকে উপকারী জৈব সার তৈরিতে কাজ করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ছবি: গার্ডিয়ানের সৌজন্যে।
মানববর্জ্য থেকে উপকারী জৈব সার তৈরিতে কাজ করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। ছবি: গার্ডিয়ানের সৌজন্যে।

এই তো কদিন আগেই মানববর্জ্য থেকে উৎপন্ন পরিশোধিত পানি পান করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলেন মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। মানববর্জ্য এখন দরকারি কাজে লাগানো যাচ্ছে এবং এই বর্জ্য ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ জৈব সার, মাছের খাবারের মতো উপাদানও তৈরি করা যাচ্ছে। মানববর্জ্য ব্যবহার করে জৈব সার তৈরিতে কাজ করছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা।
মানববর্জ্য কাজে লাগিয়ে তা থেকে নিরাপদ, জৈব উপাদানসমৃদ্ধ সার তৈরি করতে কাজ করেছেন বুয়েটের কেমিক্যাল প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মমিনুর রহমান। তাঁর গবেষণার বিষয়টি নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান-এর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে একটি ফটো স্টোরি। বাংলাদেশে মানববর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে জৈব সার তৈরির গবেষণা সম্পর্কে জানতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
মমিনুর রহমান জানান, নেদারল্যান্ডসের অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণা প্রকল্পটি মূলত ব্র্যাক ওয়াস প্রোগ্রামের আওতাভুক্ত। এটি ত্রিদেশীয় একটি গবেষণা প্রকল্প। এই প্রকল্পে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন। প্রায় দুই বছর আগে ছোট আকারে এই গবেষণা শুরু করা হয়। এই প্রকল্পের অন্যান্য অংশীদার হিসেবে ছিল লিডস ইউনিভার্সিটি, ইউকে, শ্রীলঙ্কার ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (আইএমডব্লিউআই) এবং বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ।
মমিনুর রহমান বলেন, ‘মানববর্জ্য সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়ে তা থেকে নিরাপদ জৈব সার তৈরি করার লক্ষ্যে এই প্রকল্পে কাজ শুরু করি। এই প্রকল্পের কারিগরি দিকনির্দেশনার ভার ছিল আমার ওপরে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের লক্ষ্য ছিল দেশের আবহাওয়া উপযোগী কার্যকরী উপায়ে মানববর্জ্য থেকে প্যাথোজেন ধ্বংস করা এবং তা থেকে মানসমৃদ্ধ জৈব সার প্রস্তুত করা। সাধারণ কম্পোস্ট সার তৈরির যে প্রচলিত পদ্ধতি বাংলাদেশে বর্তমান আছে, তা থেকে এই পদ্ধতি কিছুটা ভিন্নমাত্রার। এ ক্ষেত্রে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করে উচ্চ তাপমাত্রা, যাতে প্যাথোজেন দ্রুত ধ্বংস হয়।
সার তৈরি প্রসঙ্গে মমিনুর রহমান বলেন, ‘মানববর্জ্য সাধারণত মাটিচাপা দেওয়া হয় বা পানিতে গিয়ে মেশে, যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে আমাদের দেশের মাটির যে পরিমাণে জৈব অংশ থাকা দরকার, সে তুলনায় কম রয়েছে। এ ধরনের জৈব সার ব্যবহারে জমির উর্বরতা শক্তি যেমন বাড়ানো যায়, তেমনি পরিবেশের ওপর মানববর্জ্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়াও রোধ করা যায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে নির্দিষ্ট প্ল্যান্টে মানববর্জ্য শুকানো হয়। পরে তার সঙ্গে জৈব বর্জ্য যেমন ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, খড়, গোবর, শহুরে জৈব বর্জ্যের মতো উপাদান মিশিয়ে জৈবসমৃদ্ধ করে কম্পোস্ট সার প্রস্তুত করা হয়।

বাংলাদেশের গবেষক মমিনুর রহমান মানববর্জ্য থেকে উৎপাদিত জৈব সার পরীক্ষা করে দেখছেন। ছবি: গার্ডিয়ানের সৌজন্যে।
বাংলাদেশের গবেষক মমিনুর রহমান মানববর্জ্য থেকে উৎপাদিত জৈব সার পরীক্ষা করে দেখছেন। ছবি: গার্ডিয়ানের সৌজন্যে।

মানববর্জ্য কী কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা থাকে। যদি সচেতনভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তবে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাসের মতো উপাদান এই বর্জ্য থেকে পাওয়া সম্ভব বলে উল্লেখ করেন গবেষক মমিনুর। গবেষণায় দেখা গেছে যে এভাবে উৎপন্ন উচ্চমানের কম্পোস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ মান বজায় রাখতে সক্ষম।
মমিনুর বলেন, ‘আমাদের সমাজে এখন মানববর্জ্য ব্যবহার নিয়ে যে ট্যাবু আছে, তা ভেঙে ফেলা উচিত। এ ধরনের প্রক্রিয়ায় তৈরি সার সম্পূর্ণ প্যাথোজেন মুক্ত বলে তা পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। এই প্রকল্পে উৎপাদিত জৈব সার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ মানদণ্ডের ভিত্তিতে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব।’
তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে শুধু মানববর্জ্য হতে উত্পাদিত জৈব সার দেশের প্রধান ফসলের মোট চাহিদার ১৭ শতাংশ নাইট্রোজেন, ১৫ শতাংশ ফসফরাস ও ১০ শতাংশ পটাশিয়াম পূরণ করতে সক্ষম।