গুগল থেকে 'অ্যালফাবেট'

ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন
ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন

বিশাল এক পরিকল্পনা নিয়ে ‘অ্যালফাবেট’ নামের নতুন কোম্পানি খুলেছেন গুগলের দুই প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন। ওই কোম্পানির অধীনে থাকবে গুগল। গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হলেন সুন্দর পিচাই।
প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, গুগলের দুই প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিনের চিন্তাভাবনা কখনো ছোট পরিসরে আটকে থাকে না। অনেক দিন ধরেই তাঁরা গুগলকে আরও বড় করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন। ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গুগল প্রতিষ্ঠিত হয়।
গুগলকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে কত বড় করা যেতে পারে? এ প্রশ্নটি গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজকে করেছিলেন গুগলের সাবেক প্রধান নির্বাহী এরিক স্মিড। প্রশ্নের উত্তরে পেজ উল্টো জিজ্ঞাসা করলেন, মাইক্রোসফটের অধীনে কত প্রকৌশলী কাজ করেন? মাইক্রোসফটে ২৫ হাজার প্রকৌশলী আছেন শুনে তিনি বলেন, ‘আমাদের ১০ লাখ প্রকৌশলী কাজ করবে।’ আজ পেজ ও ব্রিনের উচ্চাভিলাষী সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে।
পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার পর গুগল অ্যালফাবেট নামের কোম্পানিটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে আর অ্যালফাবেটের অধীনে গুগলের মতোই বিভিন্ন উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিয়ে কাজ করবেন ব্রিন ও পেজ। ল্যারি পেজ তাই গুগলের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব ছেড়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুন্দর পিচাইয়ের কাঁধে তা পুরোপুরি চাপিয়ে দিচ্ছেন।
অ্যালফাবেট কেন?
ইংরেজির অ্যালফাবেট বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বর্ণমালা’। তবে কি গুগল বর্ণমালায় যত অক্ষর আছে, তত কোম্পানি খুলতে যাচ্ছে? ধারণাটি অনেকটাই তার কাছাকাছি। শুধু ইন্টারনেটে একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করে গুগলের যাত্রা শুরু হয়েছিল, কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এটি এখন বড় একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেনভিউ ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ওয়েব দুনিয়ার জনপ্রিয় বেশ কিছু সেবা যেমন ইউটিউব, জিমেইল তৈরি করেছে তেমনি জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েডও এসেছে গুগলের কাছ থেকে। এ ছাড়াও চালকবিহীন স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, বয়সরোধী প্রযুক্তি, বেলুনের সাহায্যে ইন্টারনেট প্রভৃতি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন মনে করছেন, তাঁরা যেসব প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছেন, তা এতটাই বিশাল যে একটি পরিচালনা প্রতিষ্ঠানের অধীনে সবকিছু দক্ষতার সঙ্গে চালানো সম্ভব হবে না। একেক ধরনের প্রকল্প চালানোর জন্য একেক ধরনের নেতৃত্ব, সংস্কৃতি ও জনবল দরকার। এ কারণেই অ্যালফাবেট তৈরি করা হয়েছে। এ কোম্পানিটি প্রতিটি প্রকল্প দেখভাল করবে। এতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।
পেজ বলছেন, তাঁর বিশ্বাস গুগলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে দিলে তা তাদের জন্য সহজ হবে।

গুগলের নতুন প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিশাই
গুগলের নতুন প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিশাই

গুগলের দায়িত্বে সুন্দর পিচাই
গুগলের নতুন প্রধান নির্বাহী হয়েছেন সুন্দর পিচাই। ২০০৪ সাল থেকে গুগলে কাজ করছেন তিনি। গত বছরে গুগলের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে যে রদবদল ঘটেছিল তাতে তিনি ল্যারি পেজের শীর্ষ সহযোগী হয়ে উঠে এসেছিলেন।
গুগলের কাজ করার সময় বিভিন্ন পণ্য ও সেবা তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ২০০৮ সালে তৈরি হওয়ার গুগলের জনপ্রিয় ব্রাউজার গুগল ক্রোম ব্রাউজার তৈরিতে তাঁর অবদান রয়েছে। ফরচুন সাময়িকীতে লেখা হয়েছে, ক্রোমের সফলতা সুন্দর পিচাইয়ে উঠে আসার পেছনে ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করেছে। এ ছাড়াও গুগলের জনপ্রিয় মেইল সেবা জিমেইল ও অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত বছরে গুগলের সার্চ ইঞ্জিনসহ বেশির ভাগ সেবাগুলো তাঁর অধীনে দেওয়া হয়। এ বিষয়টিই তাঁকে প্রধান নির্বাহী হিসেবে ল্যারি পেজের উত্তরসূরির জায়গায় এনে দিয়েছে।
গুগলে পরকীয়া ও রাজনীতির খেলা

প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, গুগলের মধ্যে পিচাইয়ের দারুণ জনপ্রিয়তা রয়েছে। গুগলের করপোরেট রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য অনেকে তাঁকে পছন্দ করেন।

ল্যারি পেজের লক্ষ্য বুঝতে পেরে সে অনুযায়ী কৌশল প্রয়োগ করেছেন সুন্দর পিচাই। ফলও এসেছে সে অনুযায়ী। এ কাজে অবশ্য ল্যারি পেজের প্রশংসাও পেয়েছেন পিচাই।

ল্যারি বলেন, ‘কিছুদিন ধরে আমার কথাগুলোই সুন্দর বলছে। আমরা একত্রে কাজ করার এই বিষয়টি উপভোগ করছি। গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে যখন তিনি আমাদের ইন্টারনেট ব্যবসার পণ্য ও প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এরপর থেকে তিনি সত্যিকারের নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন।’
ল্যারি ও ব্রিন এখন যা করবেন
ল্যারি পেজ এখন অ্যালফাবেটের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করবেন। সের্গেই ব্রিন হবেন এর প্রেসিডেন্ট। পেজ বলেন, তিনি আশা করছেন অ্যালফাবেটের মাধ্যমে এখন আরও বড় পরিসরে কাজ করা সম্ভব হবে। নতুন কিছু নিয়ে কাজ করা যাবে। তবে অ্যালফাবেটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে।
পেজ বলেন, ‘আমাদের মডেল হচ্ছে প্রতিটি ব্যবসার জন্য একজন করে শক্তিশালী প্রধান নির্বাহী তৈরি করা। আমি আর ব্রিন মিলে সেই প্রধান নির্বাহীদের প্রয়োজন অনুসারে সেবা দিয়ে যাব। প্রতিটি ব্যবসা যাতে ঠিকঠাক মতো চলে এ লক্ষ্যে আমরা ব্যবসায় অর্থের বরাদ্দের বিষয়টি ঠিকঠাক রাখব। আমাদের কাজ হবে নতুন ব্যবসা তৈরি করা।’
প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, নতুন কোম্পানি তৈরির ফলে এখন থেকে ব্রিন ও পেজ নতুন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার ফুসরত পাবেন।
পেজ বলেন, বিশেষ পণ্য এনে বড় কনজুমার ব্র্যান্ড হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা অ্যালফাবেট তৈরি করছেন না। মূল বিষয়টি হচ্ছে-অ্যালফাবেটের অধীনে যে কোম্পানিগুলো থাকবে, তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাতে পারবে।গুগলের নতুন সিইও ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুন্দর পিশাই

অ্যালফাবেট গঠন যেমন হবে
শেয়ারহোল্ডারদের দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে-গুগলের নাম বদলে অ্যালফাবেট করা হচ্ছে। গুগলের শেয়ার হয়ে যাবে অ্যালফাবেটের শেয়ার। সব অ্যালফাবেট কোম্পানিতে গুগলের শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার থাকবে। এখনো অবশ্য অ্যালফাবেটের পুরো গঠন কাঠামো প্রকাশ করা হয়নি, তবে পেজ বলেছেন, গুগল থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ সরিয়ে নেওয়া হবে এবং সেগুলো আলাদা কোম্পানি হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কন্টাক্ট লেন্স তৈরি করার মতো লাইফ-সায়েন্স গবেষণা। এ ছাড়াও রয়েছে মানুষকে দীর্ঘায়ু করার প্রকল্প ক্যালিকো, নতুন পণ্য তৈরির এক্স ল্যাব, গুগলের বিনিয়োগ কোম্পানি ভেঞ্চার্স অ্যান্ড ক্যাপিটাল প্রভৃতি।
গুগল ব্যবহারকারীদের ওপর যে প্রভাব পড়বে
গুগলের যাঁরা বিভিন্ন সেবা ব্যবহার করছেন, তাঁদের ওপর আপাতত কোনো প্রভাব পড়বে না। গুগলের যেসব পণ্য সচরাচর ব্যবহৃত হয় তা গুগলের অধীনে থেকেই পরিচালিত হবে। দীর্ঘ মেয়াদের অ্যালফাবেট মানুষের জীবনে প্রভাব রাখতে পারে। যেমন মানুষকে দীর্ঘায়ু করার প্রকল্প ক্যালিকোর মাধ্যমে মানুষের বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে।
পেজ নিজেও জানেন, যেসব উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নিয়ে ‘জুয়া’ খেলতে যাচ্ছেন, এতে ঝুঁকি থাকছে। একটি প্রকল্প সফল হলেই সার্থকতা। (ভক্স, ফরচুন, বিবিসি)