ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ছে না কেন?

ইন্টারনেট-সেবার উচ্চমূল্য, অবকাঠামোগত সমস্যা ও ইন্টারনেটে বাংলা কনটেন্টের অভাবের কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। কার্যকর ব্যবস্থার মাধ্যমে ইন্টারনেটের সুফল দেশের মানুষকে দিতে না পারলে এ নিয়ে সরকারের সব পরিকল্পনা হোঁচট খেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে সরকার মনে করছে, তারা সঠিক পথেই এগোচ্ছে। ইন্টারনেটের প্রাপ্যতা, তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা এবং এ বিষয়ে সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষকে ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করে সরকার।
গত সোমবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৬: ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারনেট সুবিধাবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এখানকার প্রায় ১৪ কোটি ৮০ লাখ লোক ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে, যাদের বিশ্বব্যাংক ‘অফলাইন’ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অথচ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ১২ লাখ।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যার প্রশ্নে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্যে বিপুল ফারাক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিটিআরসি যে উপায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তথ্য দেয়, সেটা কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও অন্য সংগঠনগুলো যেসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেটাও যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নয়।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নির্ধারণে বিটিআরসির অনুসরণ করা মানদণ্ড হলো, ৯০ দিন বা তিন মাসের মধ্যে একজন ব্যক্তি একবার ব্যবহার করলেই তিনি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংজ্ঞা হলো একজন ব্যবহারকারীকে নিয়মিতভাবে তা ব্যবহার করতে হবে। অফিসের পাশাপাশি নিজের বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা থাকতে হবে। তা ছাড়া ২০১৪ সালের আগস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের অধীন প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) ও ইউনেসকো প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অব ব্রডব্যান্ড ২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বা দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অথচ ওই সময় বিটিআরসির তথ্যানুয়ায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ বা ৫ কোটি ২২ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও শ্রীলঙ্কাভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সায়ীদ খান মনে করেন, বিটিআরসি যদি সঠিক তথ্য সরবরাহ করত, তাহলে তথ্যগত বিভ্রাট থাকত না। তারা বাহবা কুড়ানোর জন্য ভ্রান্ত ও অসম্পূর্ণ তথ্য দিচ্ছে। আর বিশ্বব্যাংক দুই বছর আগের তথ্য নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বর্তমান সময়ের সত্যিকার চিত্র উঠে আসা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। তাই ওই প্রতিবেদনও গ্রহণযোগ্য নয়।
বিশ্বব্যাংক ও বিটিআরসি উভয়ের তথ্য নিয়ে দ্বিমত থাকলেও ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার বিষয়ে দ্বিমত নেই বিশেষজ্ঞদের।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার মনে করেন, ইন্টারনেট ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত, ইন্টারনেট অবকাঠামো ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেটের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। তৃতীয়ত, ইন্টারনেটে দেশি এবং দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্টের অভাব। সরকার ব্যান্ডউইট্থের দাম কমালেও এর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে যায়নি।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব টি আই এম নুরুল কবীর ইন্টারনেটের সহজপ্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, সরকার অনেকভাবে দাম কমানোর উদ্যোগ নিলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ব্যবহারকারীদের উচ্চমূল্য গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি এ খাতের ওপর নানা ধরনের কর রাখারও সমালোচনা করেন তিনি।
সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেন, দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। মানুষকে ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতন করার কারণেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করার অংশ হিসেবে থ্রিজি প্রযুক্তি এসেছে। গত সাত বছরে দামও অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। সবার জন্য কনটেন্ট তৈরিতে নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির লক্ষ্যে সরকার সঠিক পথেই এগোচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি যে পরিকল্পনা ও গতিতে আমরা এগোচ্ছি, তাতে ২০২১ সালের মধ্যেই এ দেশের শতভাগ মানুষ ইন্টারনেটের আওতায় আসবে।’