বিজয় সফটওয়্যারের ২৫ বছর

মোস্তাফা জব্বার। ছবি: খালেদ সরকার
মোস্তাফা জব্বার। ছবি: খালেদ সরকার

‘সব ধরনের কম্পিউটার যন্ত্রে, সব অপারেটিং সিস্টেমে বিজয় দিয়ে বাংলা লেখা যাবে, এ বিষয়টা নিশ্চিত করা এখন মূল লক্ষ্য। এ জন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ বাংলা লেখার সফটওয়্যার বিজয়ের নির্মাতা মোস্তাফা জব্বার এমনভাবেই বললেন তাঁর স্বপ্নের কথা। তাঁর এই স্বপ্নের শুরু গত শতকের আশির দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর কম্পিউটারে বাংলা লেখালেখির জন্য প্রথমবারের মতো বিজয় ব্যবহার করা হয়। কারিগরি দিক থেকে বিজয় একটা ইন্টারফেস। লেখালেখির অন্য কোনো সফটওয়্যারকে ব্যবহার করে বাংলা লেখার কাজটি করে দেয় এ প্রোগ্রাম।শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে বিজয়। একটা সময় বাংলা টাইপ যাঁরা করতেন, তাঁদের মুনীর লে-আউট মুখস্থ ছিল। এখন পেশাদার কাজের প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই বিজয় লে-আউট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মোস্তাফা জব্বারের কাছ থেকে জানা যায়, ‘দেশের বাজারে বৈধভাবে প্রতি মাসে গড়ে ৩২ হাজারের বেশি বিজয় লে-আউট ছাপানো কি-বোর্ড আমদানি হয়। আবার বিজয় সফটওয়্যারের বিক্রির পরিমাণও প্রতি মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার।’

২৫ বছরে বিজয় যেমন জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে, তেমনি প্রযুক্তির পরিবর্তন ও উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হালনাগাদও করা হয়েছে এই সফটওয়্যারের। ‘সব সময় একটা দল কাজ করে বিজয়ের উন্নয়নে। প্রোগ্রামিং পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ বললেন মোস্তাফা জব্বার।
আশির দশকের শুরুর দিকে এ ধরনের ভাবনা শুরু করেন মোস্তাফা জব্বার । ১৪৫৪ সালে মুদ্রণশিল্পে সিসার টাইপের যে যাত্রা শুরু, সেটির তখন বিদায় ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। মনোটাইপ-লাইনোটাইপ, ফটোটাইপ সেটার প্রযুক্তি যুক্ত হতে যাচ্ছে মুদ্রণশিল্পে। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে প্রথম ফটোটাইপ সেটার আসে পরিসংখ্যান ব্যুরোতে। এরপর দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক খবর ও জেনিথ প্রেসে আসে আধুনিক এই যন্ত্র। এ রকম সময়ে ১৯৮৩ সালে মাসিক নিপুণ পত্রিকার দায়িত্ব নেন মোস্তাফা জব্বার। ‘পত্রিকায় তখন আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। ফটোটাইপ সেটারে ঝকঝকে হরফে বাংলা ছাপা হচ্ছে। এ প্রযুক্তিতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার অবদানই বেশি। তাদের তৈরি করা ফন্টই আমাদের এখানে ব্যবহূত হতে থাকল।’

১৯৮৬ সালে লন্ডনে ফটোটাইপ সেটার যন্ত্র কিনতে যান মোস্তাফা জব্বার। দাম বেশি হলেও যন্ত্র পছন্দ হলো তাঁর। কিন্তু লন্ডনে তখন তিনি দেখলেন, অ্যাপল কম্পিউটার ইনকরপোরেটেড তখন ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার বাজারে ছেড়েছে। ‘একটি কম্পিউটার, একটি লেজার প্রিন্টার দিয়েই টেবিলে বসে প্রকাশনার কাজ সারা যায়। যেটার নাম ডেস্কটপ পাবলিশিং (ডিটিপি)। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এ যন্ত্রে বাংলাও লেখা যায়। আমাদের প্রচলিত টাইপের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন বঙ্কিম নামে একটা ফন্টও আছে।’ মোস্তাফা জব্বার ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার কিনে নিয়ে এলেন। সৈয়দ মইনুল হাসান বঙ্কিমকে একটু পরিবর্তন করে বানালেন মইনুল লিপি। আর অপটিমা মুনীর লে-আউটের ওপর আরও দুটি স্তর যোগ করে জব্বার কি-বোর্ড তৈরি হলো।

‘১৯৮৭ সালের ১৬ মে ম্যাক কম্পিউটার দিয়ে বের হলো সাপ্তাহিক আনন্দপত্র। আমি অ্যাপলের পুনর্বিক্রেতা হলাম। বাংলা লেখার ব্যবস্থাসহ ম্যাক কম্পিউটারের ব্যবহার হতে থাকল বাংলার বাণী, দৈনিক দেশ পত্রিকায়।’
তবে অপটিমা মুনীরের ওপর আরও দুই স্তরের বোতাম থাকায় টাইপ করার গতি বেশ শ্লথ হতে থাকে। এ সমস্যার সমাধান একটাই, প্রোগ্রাম বানাতে হবে। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে দেবেন্দ্র যোশীকে দিয়ে মোস্তাফা জব্বার তৈরি করালেন ৩ কিলোবাইটের প্রোগ্রাম—বিকেবিডি। অ্যাসেম্বলি ভাষায় লেখা এ প্রোগ্রাম দিয়ে নরমাল ও শিফট ব্যবহার করে এটি দিয়ে বাংলা বর্ণের সবই প্রায় লেখা যেত। একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় নামে এটি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ছাড়া হয়। সে সময় ম্যাক এসই, ম্যাক +৫১২ কেই আর ম্যাক-টু কম্পিউটারে বিজয় দিয়ে কাজ করা যেত।

বিজয় নামটি কার দেওয়া? মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘আমার মেয়ে সুনন্দা শারমীনের। পরে এই বিজয়ের নামে আমার ছেলের নাম রেখেছি।’ ম্যাক কম্পিউটারে বিজয় আসার পর মুদ্রণশিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন চলে এল। ১৯৮৯ সালের মধ্যেই ফটোটাইপ সেটারের জায়গা দখল করল ম্যাকনির্ভর ডিটিপি। মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এরপর আমরা দেখলাম কিছু যুক্তাক্ষর লিখতে সমস্যা হচ্ছে। প্রোগ্রামটা আসলে তো করা হয়েছিল ভারতীয় বাংলা ধরে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজের ঘরেই প্রোগ্রাম তৈরি করতে হবে।’ তখন তাঁর ভগ্নিপতি গোলাম ফারুককে দায়িত্ব দেওয়া হলো প্রোগ্রাম লেখার। ‘১৯৯২ সালে আমাদের প্রোগ্রামিং করা বিজয় পেলাম।’ গোলাম ফারুক পরবর্তী সময়ে আলাদাভাবে লেখনী নামে বাংলা প্রোগ্রাম তৈরি ও বাজারজাত করেন।

১৯৮৯ সালেই বিজয়ের কপিরাইট করে নেয় আনন্দ কম্পিউটার্স। মোস্তাফা জব্বারের মতে, ‘মেধাস্বত্ব না থাকলে মেধার মূল্য থাকে না। বাংলা সফটওয়্যার নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে আমার তো প্রটেকশন দরকার।’
এদিকে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে দেশে আইবিএম ঘরানার পার্সোনেল কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়তে থাকে। ম্যাক ব্যয়বহুল তখন। ‘আমরা ডস-এর জন্য ওয়ার্ড প্রসেসর তৈরি করা শুরু করলাম। কাজটা যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম চলে এল। ওয়ার্ড প্রসেসর ফেলে রেখে বিজয়ের উইন্ডোজ সংস্করণ প্রকাশ করা হলো ১৯৯৩ সালে।’

এর পর থেকে ক্রমাগত উন্নয়নকাজ চলছে বিজয়ের। বিজয় ইউনিকোড, লিনাক্সের জন্য বিজয়, অ্যান্ড্রয়েডের জন্য বিজয়—আনন্দ কম্পিউটার্স প্রতিনিয়ত এ সফটওয়্যারের উন্নয়ন করে যাচ্ছে। প্রোগ্রামিং, টাইপোগ্রাফি ইত্যাদি কাজে অনেকেই যুক্ত থেকেছেন বিজয়ের পথচলায়। এখনো এ কাজে আছেন বেশ কয়েকজন। ২০০৪ সালে বিজয় কি-বোর্ড লে-আউটের পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন মোস্তাফা জব্বার। পেটেন্ট-স্বত্ব পান ২০০৮ সালে।
নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেটে বাংলা লেখার জন্য অভ্রতে বিশেষ করে ফোনেটিক কি-বোর্ডে অভ্যস্ত বেশি। এতে বিজয় লে-আউটের ব্যবহার ভবিষ্যতে কি কমে যাবে না? মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ফোনেটিক মানে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখা। এ পদ্ধতিতে বানান শুদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। পেশাদার কাজে বিজয় ব্যবহার কখনো কমবে না। বিজয়ের লে-আউটটা কম্পিউটারে ব্যবহারের জন্য অনেক সহজ ও ব্যাকরণসম্মত। তাই শুদ্ধ বাংলা লেখার জন্য বিজয় থাকবে।’
মোস্তাফা জব্বার বিজয়ের নানা পর্যায়ে অনেক মানুষকে সম্পৃক্ত করেছেন। ‘অনেককেই তৈরি করে নিচ্ছি। এঁরাই আগামী দিনে হাল ধরবেন বিজয়ের।’

বিজয় উন্নয়নে যাঁরা কাজ করেছেন
প্রোগ্রামিং: দেবেন্দ্র যোশী, গোলাম ফারুক আহমেদ, কামরুজ্জামান, নিয়াজ মোহাম্মদ, মনিরুল আবেদন, রিফাত উন নবী,
অর্পিতা উর্মি, শোভন, তাহমিনা তাহা ও মইনুদ্দিন সালেহ।
টাইপোগ্রাফি: হামিদুল ইসলাম,
শিব নারায়ণ দাশ, উজ্জ্বল কুমার মজুমদার, মাকসুদ আহমেদ ও মজিবুর রহমান।


বিজয়

২৫ বছরের পথ চলা
নির্মাতা: আনন্দ কম্পিউটারস
১৯৮৭
১৬ মে
সাপ্তাহিক আনন্দপত্র
১২ সেপ্টেম্বর
আনন্দ ফন্ট
১৯৮৮
১৬ ডিসেম্বর
বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার
১৯৮৯
বিজয়ের কপিরাইট
১৯৯২
১৬ ডিসেম্বর
ম্যাকিন্টোশ বিজয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ
১৯৯৩
২৬ মার্চ
উইন্ডোজের জন্য বিজয়ের প্রথম সংস্করণ
১৯৯৯
২৬ মার্চ
উইন্ডোজ বিজয়ের হালনাগাদ
২০০০
১৩ অক্টোবর
উইন্ডোজ বিজয়ের হালনাগাদ
২০০৫
১৩ অক্টোবর
ম্যাকিন্টোশ বিজয়ের হালনাগাদ
ইউনিকোডভিত্তিক উইন্ডোজ বিজয়
২০০৭
৯ ডিসেম্বর
ম্যাক ও উইন্ডোজ বিজয় হালনাগাদ
২০০৮
বিজয় কিবোর্ড লেআউটের পেটেন্ট
২০১২
২৭ জুন
লিনাক্সের জন্য বিজয়
২০১৩
২৬ মার্চ
অ্যান্ড্রয়েডের জন্য বিজয়
১৬ ডিসেম্বর
বিজয় একাত্তর প্রো