এসিডে দৃষ্টি হারিয়েছেন ফেরদৌসী কিন্তু থামেনি শিক্ষাজীবন

সকালে ঘুম থেকে জেগেই বেরোনোর প্রস্তুতি শুরু হয়। কোনোরকমে কিছু মুখে দিয়ে হাতে সাদাছড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। রিকশার খোঁজে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন মিরপুর-১। কাউন্টারে লাইন ধরে সিটিবাসে উঠে নীলক্ষেত নামেন। আবার সাদাছড়ি বের করে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সিঁড়ির ধাপ গুনে গুনে তৃতীয় তলায় উঠে ক্লাস করেন প্রতিদিন। দৃষ্টিহীন, এটা টের পেয়ে রিকশাওয়ালা কিংবা বাস কাউন্টারের লোক প্রায়ই তাঁকে ঠকায়। এ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফেরদৌসী আক্তারের দিনলিপি। এসিডে তাঁর দুটি চোখই ঝলসে যায়। এসএসসি পর্যায়ে দৃষ্টিহীন হয়েছিলেন, এখন তিনি স্নাতক শ্রেণীতে পড়ছেন। মা মারা গেছেন আর বাবা থেকেও নেই; এই ঢাকা শহরে তাঁর আপন বলতে কেউ নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার মতো আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও ফেরদৌসী থেমে থাকেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে শামসুননাহার হলে সিটের জন্য হল প্রাধ্যক্ষের কার্যালয়ে ঘোরাফেরা করছেন, কিন্তু সিট এ বছর পাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন হল প্রাধ্যক্ষের কার্যালয়ের কর্মকর্তা। দৃষ্টিহীন হওয়ায় কারও সঙ্গে দেখাও করতে পারছেন না। নিরুপায় হয়ে যখন ভাবছেন পড়াশোনা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন, ঠিক তখনই এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান ফোন করে বললেন, প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের পক্ষ থেকে ফেরদৌসীকে কোনো সহযোগিতা করা যায় কি না। পরদিন ফেরদৌসীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি জানালেন, ‘এ মুহূর্তে আমার থাকার জায়গা নেই, শিক্ষা-খরচ কীভাবে মেটাব তাও জানা নেই। সমাজের কাছে করুণা নয় বরং পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রমাণ করতে চাই আমরাও (এসিডদগ্ধরা) পারি।’ সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে ফেরদৌসীকে অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও অধ্যাপক রাজিয়া আকতার বানুর সহযোগিতায় ঢাকায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দৃষ্টিহীন হলেও থেমে থাকেননি এসএসসি পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন ডুগডুগিহাট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী ফরদৌসী। দিনাজপুর হাকিমপুর থানার মহেশপুর মাটিকাটা গ্রামের মো. রহিম উদ্দিনের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকতেন ফেরদৌসী আক্তার। তাঁর সহপাঠী সাখাওয়াত হোসেন তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ফেরদৌসীকে এসিড মারবে বলে সে হুমকি দেয়। ফেরদৌসী বোনদের নিয়ে বাড়ির উঠানে (২০০০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বেলা একটায়) বরইয়ের আচার খাচ্ছিলেন। বাড়ির পেছন দিয়ে ঢুকে সাখাওয়াত হোসেন এসিড ছুড়ে মারে ফেরদৌসীকে। এসিডে তাঁর সারা মুখ, দুই চোখ, গলা ও হাত ঝলসে যায়। জেলা সদর দিনাজপুরের চেয়ে জয়পুরহাট কাছে হওয়ায় ফেরদৌসীকে জয়পুরহাট হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেড় মাস চিকিত্সা শেষে তাঁকে ঢাকার মনোয়ারা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মনোয়ারা হাসপাতালে তাঁর কয়েকটি অপারেশন হয়। এএসএফের সহযোগিতায় তাঁর চোখের চিকিত্সা করানো হয়। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাননি ফেরদৌসী। পরীক্ষার মাত্র ১৯ দিন আগে এসিডদগ্ধ হওয়ায় সে বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া হয়নি তাঁর। পরে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ার অভিজ্ঞতা না থাকায় এসএসসি পরীক্ষার্থী ফেরদৌসীকে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হতে হয়। ২০০৪ সালে জিপিএ-৩.৮১ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে একাদশ শ্রেণীতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। ওই কলেজের ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। ২০০৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এ গ্রেডে পাস করেন। বর্তমানে ফেরদৌসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটে সম্মান শ্রেণীতে বিশেষ শিক্ষা বিভাগে পড়ছেন। এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন থেকে তাঁকে কিছুটা সহায়তা করা হচ্ছে। তবে তা দিয়ে ফেরদৌসীর শিক্ষাজীবনের সব খরচ চালানো সম্ভব নয়। ফেরদৌসীর স্বপ্ন—একদিন তিনি শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে ভালো একটা চাকরি নিয়ে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এসিডদগ্ধ ফেরদৌসী আক্তার বললেন, ‘আমার জন্মের ছয় মাস পর যৌতুকের কারণে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। সংগত কারণে দুই মেয়েসহ আমার মা দ্বিতীয় বিয়ে করেন মাটিকাটা গ্রামের মো. রহিম উদ্দিনকে। রহিম উদ্দিনের (সত্বাবা) বাড়িতে আমরা দুই বোন বেড়ে উঠি। ইতিমধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়। রহিম উদ্দিনের বড় ভাই তায়েজ উদ্দিনের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন ও আমি একসঙ্গে স্কুলে পড়তাম। ও বিয়ের প্রস্তাব দেয় আমাকে। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে এসিড ছুড়ে মারে।’ ফেরদৌসী জানিয়েছিলেন, আগে পড়াশোনা শেষ হোক, তারপর চিন্তা করা যাবে। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে ছিল এসিড-সন্ত্রাস। সত্বাবা মো. রহিম উদ্দিনের ভাইপো সাখাওয়াত হোসেন। আসামির সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় মামলা করার কারণে উল্টো ফেরদৌসীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের বাড়ি থেকে। আর কোনো খোঁজখবর নেয়নি তাঁদের। অগত্যা মা ও মেয়ে ঢাকায় চলে আসেন। সেই থেকে ফেরদৌসীর মা মাহমুদা বেগম ঢাকার মিরপুরে ডেন্টাল মেডিকেল সেন্টারে আয়ার কাজ করে সংসার চালাতেন। গত ৭ মে ফেরদৌসীর একমাত্র অবলম্বন মা মারা যান। প্রসঙ্গত ফেরদৌসীর প্রকৃত বাবা সিদ্দিক আলী বেঁচে আছেন, কিন্তু কোন খোঁজ নেন না। এসিড নিক্ষেপকারী সাখাওয়াত হোসেনকে আসামি করে মামলা করা হয়। ২০০২ সালের ১০ জানুয়ারি মামলার রায়ে আদালত আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন। সাখাওয়াত হোসেন এখন রংপুর কারাগারে। ফেরদৌসীর মা মারা যাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ চালানো তাঁর জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। দৃষ্টিশক্তি না থাকায় অন্য মেয়ের মতো পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি বা অন্য কিছুই করা সম্ভব নয়। প্রথম আলো সহায়ক তহবিল এখন থেকে ফেরদৌসীর পাশে থাকবে। যাতে তিনি শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেন। তবে এ কথাও ঠিক, ফেরদৌসীর অতীত বলছে কেউ না থাকলেও তিনি নিজেকে এগিয়ে নিতে পারবেন। সেই মনোবল তাঁর আছে। এসিড-সন্ত্রাসী তাঁর দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু মনোবল তো কেড়ে নেয়নি!