পড়ুন শিশু বাবলির দুঃখগাথা

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে ৮ মার্চ বিকেলে ছোট্ট বাবলির কাহিনী উপস্থিত সবাইকে কাঁদিয়ে ছিল। পরদিন প্রথম আলোয় তার ছবি ও দুঃখের কথা ছাপা হয়। এরপর অনেক পাঠক ফোন করেন প্রথম আলো অফিসে। তারা বাবলি সম্পর্কে আরও জানতে চান। কেউ শুধু নিজের আবেগের কথা জানাতে ফোন করেন। বাবলির সঙ্গে প্রথম দেখা গত ৫ মার্চ ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের একটি বাসায়। সন্ধ্যার পর সেখানে গানের মহড়া চলছিল। এর মধ্যে লোডশেডিং। মোমবাতি জ্বালিয়ে ‘লীলাবালি, লীলাবালি…’ গানের সঙ্গে নাচছিল বাবলি। তখনোই জানা গেল ভয়ঙ্কর তথ্য—শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে পাষণ্ড বাবা মাত্র সাত মাসের বাবলির মুখের ভেতর ঢেলে দেয় এসিড! জীবনের শুরুতেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয় তার। তাই এসিডদগ্ধ চার নারীর সঙ্গে ছয় বছরের বাবলিও প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের উদ্যোগে ৮ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। অন্যরা জানালেন, বাবলিও তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে নাচবে। সে সময়ই কথা হয় বাবলির সঙ্গে— কোন স্কুলে পড়ো? (কথা জড়ানো) ফার্মগেট ক্যাথলিক বিদ্যালয়ে কেজিতে পড়ি। বড় হয়ে কী হবে? বড় হয়ে পুলিশ হব, বাবাকে জেলে দেব। কেন? ‘বাবা আমাকে এসিড খাওয়াইছে।’ আর ৮ মার্চ বিকেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে ছোট্ট বাবলির নাচ শেষে মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই তার প্রতি গভীর ভালোবাসায় অনেক দর্শক উঠে দাঁড়ান। অনেকেই তাকে কোলে নিয়ে আবেগে কেঁদে ফেললেন। দীর্ঘক্ষণ আদর করেন তাকে। পত্রিকায় এ ছবি এবং তার করুণ কাহিনী ছাপার পর অসংখ্য পাঠক টেলিফোন ও ই-মেইলে জানতে চান বাবলি সম্পর্কে। এরপর বনানীতে বাবলির মা পারুলের সঙ্গে তার কর্মস্থল এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনে (এএসএফ) কথা হয়। পারুল জানান, বাবলির বয়স যখন সাত মাস, তখন তার বাবা (বখতিয়ার রানা) ড্রপার দিয়ে ওর মুখে এসিড ঢেলে দেয়। কারণ সে বাবলির জন্মের আগে থেকেই বলে আসছিল তার দরকার ছেলে। সে কোনো মেয়েসন্তানের বাবা হতে চায় না। সেদিনের সেই কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন পারুল। জানান পাষণ্ড স্বামীর কথা। বলেন, পেশায় কাঠমিস্ত্রি বখতিয়ার বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য তাকে মারধর করত। আর বলত, ‘মেয়ে হলে বিয়ের সময় যৌতুক দিতে হবে আর ছেলে হলে উল্টো যৌতুক পাওয়া যাবে।’ পারুল বিয়ের তিন মাস পর গর্ভবতী হলে বখতিয়ার অসন্তুষ্ট হয়। জ্বর হওয়ার সুযোগে পরিকল্পিতভাবে গর্ভপাতের ওষুধ খাইয়ে দেয়। পরে আবার গর্ভবতী হলে বাচ্চা নষ্ট করতে চায় রানা। পারুল রাজি হননি। নিরুপায় হয়ে বাবার বাড়ি আশ্রয় নেন। ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাবলির জন্ম হয়। মেয়ে হওয়ার কারণে জন্মের পর থেকে বখতিয়ার শিশু বাবলিকে শুধু গালমন্দ করত না, হাত-পায়ে মারতও। যে কারণে এখনো বাবলি ভালো করে হাঁটতে পারে না। কাঠমিস্ত্রি হিসেবে রং করার জন্য যে এসিড ছিল, একদিন ড্রপার দিয়ে বাবলির মুখে তা ঢেলে দেয় রানা। এসিড ঢালার পর বাবলিকে তার মা পারুল হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে বখতিয়ার বাধা দেয়। ঘটনার পর থেকে রানা পলাতক। বাবলির মা কোলের সন্তানকে ঢাকায় আদ-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করান। পরে এএসএফের ‘জীবনতারা’ হাসপাতালে ভর্তি করান, সেখানে দীর্ঘদিন চিকিত্সা চলে বাবলির। চিকিত্সকরা জানান, বাবলির বাঁ কান বিকৃত, জিভ ও নিচের ঠোঁট মাঢ়ির সঙ্গে লেগে গেছে। ফলে জিভ নাড়াচড়া করতে পারে না। বাঁ পায়ের আঙুলগুলোর গ্রন্থি নষ্ট হয়ে একত্রে লেগে আছে। কান, জিভ ও পায়ের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। পারুল বর্তমানে এএসএফের আইনি সহায়তা বিভাগে কাজ করছেন। বাবলিকে নিয়ে বনানীতে থাকেন। ও স্কুল থেকে ফিরে এএসএফের হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে গোটা দিন কাটায়। হাসপাতালে চিকিত্সাধীন নারী-পুরুষ, নার্স ও চিকিত্সক সবার সঙ্গে ভাব বাবলির। সবাই তাকে আদর করেন। সে কাউকে স্যালাইন খাইয়ে দেয়, ওষুধ এগিয়ে দেয়, খেলা করে। বাবলির জীবনের লক্ষ বদলেছে, বড় হয়ে সে পুলিশ না হয়ে চিকিত্সক হতে চায়, চায় মানুষের সেবা করতে। জিহ্বাটা নিচের দিকে আটকে থাকার কারণে কথা জড়িয়ে যায়। সম্প্রতি তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। পারুলের একার আয়ে সংসার চলে। মা আর মেয়েকে নিয়ে পারুলের তিনজনের সংসার। বাবলিকে এসিড খাওয়ানোর পর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বেতাগী গ্রামের করিম সওদাগরের ছেলে বখতিয়ার রানার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ২০০০-এর ৪(১)(২) ধারায় মামলা হয়, কিন্তু আসামি পলাতক থাকায় মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। পারুল জানান, বখতিয়ার আরো একটি বিয়ে করে চট্টগ্রামেই আছে। ‘মেয়েকে চিকিত্সক বানাবেন’—পারুলের এটাই ইচ্ছা। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা চান তিনি।