শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন এসিডে ওদের স্বপ্ন পোড়েনি

অতীতটা দুঃসহ। কিছুতেই ভুলে থাকা যায় না। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। উহ্! কী ভীষণ যন্ত্রণা। এসিডের তরল আগুনে দেহ-মন গলে পুড়ে যায়। ছাই হয়ে যায় সব স্বপ্ন, সুন্দর জীবনের কল্পনা। আর আশা? তরল আগুনে তাও মিলিয়ে গিয়েছিল। কোমল দেহে চিরস্থায়ী ক্ষত, বিকৃত মুখশ্রী আর অকেজো প্রত্যঙ্গ নিয়ে মরে বেঁচে থাকার মতো দুর্বিষহ জীবনই হয়তো ওদের জন্য নির্দিষ্ট করতে চেয়েছিল কিছু মানুষরূপী অমানুষ। কিন্তু পারেনি। পারেনি ওদের মনোবলের কাছে। পারেনি মানুষের সহমর্মিতার কাছে। সব কষ্ট, যন্ত্রণা আর নিগ্রহের মধ্যে দুঃসহ অতীতটা পার করে ওরা আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ওরা হেরে যায়নি কাপুরুষদের এসিড-সন্ত্রাসের কাছে। অসহায় দিনগুলোয় তাদের পাশে এসে দাঁড়ান অনেক দরদি মানুষ। তারা এসিডদগ্ধদের জন্য ‘প্রথম আলো সহায়ক তহবিল’-এ নগদ অর্থ সাহায্য করেন। সেই সাহায্য তুলে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে এসিড-সন্ত্রাসের শিকার ১৫৯ জন নারীর হাতে—কখনো নগদ অর্থ, কখনো গরু, রিকশা, সেলাইমেশিন, এমনকি ঘরদোর পর্যন্ত। আর সেই সামান্য অর্থ ও পুঁজিকে সম্বল করে তারা নেমেছেন জীবনসংগ্রামে। হয়েছেন সফল। এসিডের বিভীষিকার মধ্যে জ্বালিয়েছেন আলোকবর্তিকা। সেই আলোর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে সমীহ জানান আশপাশের মানুষ। এমনই চারজন এসিডদগ্ধ নারীর সাফল্যগাথা নিয়ে আমাদের আজকের বিশেষ প্রতিবেদন। সেলাইমেশিনে স্বপ্ন বোনেন কুড়িগ্রামের সখিনা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের দক্ষিণ নওদাপাড়া (স্কুলের হাট) গ্রামের কাশেম মুন্সী রিকশা চালিয়ে যা আয় করতেন, তা দিয়ে স্ত্রী সখিনা খাতুন দুই ছেলে ও এক মেয়ের সংসার চালাতে পারতেন না। মাঝেমধ্যে কাশেম কামলা খাটতেন। আর আয় না থাকলে থাকতে হতো না খেয়ে। এমনই যার অবস্থা, তার মাথা গোঁজার ঠাঁই ভিটেবাড়িটার ওপর চোখ পড়ে গ্রামের অসাধু চক্রের। কাশেম ও সখিনার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ভূমি-লোলুপদের দল প্রভাবশালী বলে দরিদ্র কাশেম-সখিনার পাশে গ্রামের কেউ থাকল না। একসময় আসে বাড়ি ছাড়ার চূড়ান্ত হুমকি। তারিখটা ছিল ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০২। সেদিনও আহার জুটেছিল আধাপেট। ক্ষুধার জ্বালায় সখিনার ঘুম আসছিল না। কী করা যায়, তা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ হয়। একসময় তন্দ্রা ভাব আসে। হঠাত্ ঘরের খুঁটি কাটার শব্দে তন্দ্রা কেটে যায়। কুপি জ্বালিয়ে কাশেম বাইরে যান, কী ব্যাপার দেখতে। সেই সুযোগে জামাল, জাহাঙ্গীর ও জেদ্দার নামে তিন পাষণ্ড কাশেমকে নির্মমভাবে মারতে থাকে। স্বামীকে বাঁচাতে ছুটে যান সখিনা। পাষণ্ডরা তাকে ধরে ফেলে। দুজন দুই হাত চেপে ধরে রাখে আর অন্যজন সখিনার শরীরে এসিড ঢেলে দেয়। সখিনার ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত ঝলসে যায়। ওই রাতেই ভ্যানে চাপিয়ে সখিনাকে নেওয়া হয় নাগেশ্বরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। পরদিন ঢাকায় এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশনে আনা হয়। চার মাস চিকিত্সার পর দেহে চিরস্থায়ী ক্ষত নিয়ে সখিনা ফিরে আসেন বাড়িতে। কাশেমের দায়ের করা এসিড-সন্ত্রাস মামলার সব আসামি ধরা পড়ে। বিচারে প্রত্যেকের সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড আর প্রত্যেকের ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা হয়। কিন্তু আসামিরা হাইকোর্ট থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে কাশেম ও সখিনাকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়াতে থাকে। তখন আদালতে হাজিরা আর উকিলের টাকা জোগাতেই তাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। এমন দুর্বিষহ অবস্থায় সখিনা আত্মহত্যার কথা ভাবেন। সেই দুর্দিনে সখিনার পাশে দাঁড়ায় প্রথম আলো সহায়ক তহবিল। জেলা প্রতিনিধি সফি খান গিয়ে খোঁজ নেন, সখিনা হাতের কাজ কিছু জানেন কি না। তারপর মোট ৩৫ হাজার টাকায় সখিনাকে সেলাই মেশিন, সুতা, ব্লাউজ, পেটিকোট ও ছেলেমেয়েদের জামার কাপড় কিনে দেওয়া হয়। দুর্দিনে এই সাহায্য পেয়ে বুকে বল আর মনে জোর ফিরে পান সখিনা। প্রথমে পাখিরহাটে একটা দোকান দেন। পরে গ্রামের মহিলারা কাজ নিয়ে বাড়িতে আসতে থাকলে মেশিনটা সখিনা বাড়িতেই বসান। আর হাটে যেতে থাকেন সপ্তাহে এক দিন। এর মধ্যে সেলাইয়ের কাজটা কাশেমও শিখে ফেলেন। দুজনের কাজে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকা রোজগার হতে থাকে। খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে ১০০ টাকা। এর মধ্যেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের অন্য মেয়েদেরও সেলাইয়ের কাজ শিখিয়ে দেন সখিনা। এখন সেই মেয়েরাও সখিনার সঙ্গে কাজ করেন। এ গ্রামে সেলাইয়ের যত কাজ, সখিনা ছাড়া আর কাউকে দিয়ে কেউ করান না। সেলাইয়ের টাকা জমিয়ে সখিনা একটা ছাগল কেনেন। ছাগলের সংখ্যা এখন চার। আগের ভাঙা ঘরের বদলে এখন তার দুটো টিনের ঘর। দেড় বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছিলেন। সেই জমির গম আর বোরো ধান চাষের লাভের টাকা থেকে কিনেছেন ডিজেল ইঞ্জিন (শ্যালোমেশিন)। এখন নিজ বাড়িতেই ধান ভাঙানো হচ্ছে। দুই ছেলে রাজু ও তাজুল ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাত। তারা এখন বাড়ি ফিরে ধান ভাঙানোর কাজ দেখছে। তাদের লক্ষ্য, এ থেকে টাকা জমিয়ে একটা চাতাল দেওয়া। মেয়ে বিলকিস এখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। তাকে আরও পড়ানোর ইচ্ছা সখিনার। আর আবুল কাশেম? শুধু কাজই করেন না, বাড়ির পাশে মসজিদে ইমামতিও করেন তিনি। সবাই সম্মান করে। পরামর্শ চায়। সখিনা আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘ওমরা এসিড মারি হামাক শ্যাষ করবার চাছিল। আমরা শ্যাষ হমো না। হইবে ওমরা।’ দুটো গাভি থেকে রওশন আরার ভরা সংসার ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বগা গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেনের স্ত্রী রওশন আরা গরিব ঘরের মেয়ে হলেও ছিলেন বেশ সুন্দরী। ছোটবেলায় বিয়ে হয় তার। মোফাজ্জেল ক্ষেতে কামলার কাজ করতেন। সংসারে অভাব খুব একটা ছিল না। তাদের তিন সন্তান—জসিম, মহাসিন আর নাজমা। ছেলেদের লেখাপড়া হয়নি অর্থকষ্টের জন্য। জসিম কাজ করত বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে আর মহাসিন করত মাঠে কৃষিকাজ। নাজমার বিয়ে হয়ে যায়। দেখতে সুন্দর বলে প্রতিবেশী নূর মোহাম্মদ ও নজরুল ইসলাম প্রায়ই রওশন আরাকে উত্ত্যক্ত করত। রওশন আরা এর প্রতিবাদ করতেন। এতে খেপে যায় ওরা। দিন-তারিখ ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ২০০০ সালের মাঝামাঝি, একদিন ঘরের বারান্দায় শুয়ে থাকার সময় ওই দুই কাপুরুষ তার মুখে এসিড ঢেলে দেয়। ঝলসে যায় মুখের এক পাশ আর নষ্ট হয়ে যায় একটি চোখ। পরে একটু সুস্থ হয়ে যখন আঁচলে মুখ ঢেকে চলাফেরা করতে শুরু করেন, তখন প্রথম আলো সহায়ক তহবিল থেকে মোট ৪০ হাজার টাকা খরচ করে তাকে দুটি গাভি ও পশুপালনের অন্যান্য উপকরণ কিনে দেওয়া হয়। রওশন আরা গাভিপালন শুরু করেন। ছয় মাস যেতেই একটি গাভি বাচ্চা দেয়। এক বছর পর অন্য গাভিটিও বাচ্চা দেয়। এখন তার গরুর সংখ্যা মোট পাঁচটি। দুধ বিক্রির আয় দিয়ে রওশন আরা সংসার চালান। পাশাপাশি ৫ বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছেন। আগে ১০ শতক জমির ওপর বাড়িটি ছাড়া তাদের আর কিছুই ছিল না। এখন ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে ৫ শতক জমিও কিনেছেন। ঘরে ড্রেসিংটেবিল ও আলমারির মতো আসবাব তুলেছেন। বিদ্যুত্ সংযোগ নিয়েছেন। পাখা চলে। টেলিভিশন চলে। স্বামী মোফাজ্জেলকে আর অন্যের জমিতে কাজ করতে হয় না। দুঃসহ স্মৃতি নিয়েই লেখাপড়া করছেন যশোরের স্মরণী যশোর সদর উপজেলার ডহেরপাড়া গ্রামের গরিব কৃষক খাইরুল আলমের একমাত্র মেয়ে স্মরণীর পুরো নাম রোজিনা খাতুন। ১৯৯৯ সালে স্মরণী দশম শ্রেণীর ছাত্রী। গরমের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন বাঘারপাড়া উপজেলার পাঁচবাড়িয়া গ্রামে নানাবাড়িতে। সেখানে বখাটে যুবক সোহেল রানা তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। স্মরণী তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। খেপে যায় সোহেল। ওই বছর ১৪ জুন রাতে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে সে স্মরণীর ওপর চালায় এসিড-সন্ত্রাস। স্মরণীর মুখের ডান দিক, কান ও গলা গুরুতরভাবে পুড়ে যায়। পরদিনই স্মরণীকে ভর্তি করা হয় যশোর জেনারেল হাসপাতালে। সেখান থেকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেলে। কিছুদিন পর এক প্রাইভেট ক্লিনিকে করা হয় অস্ত্রোপচার। বাদ পড়ে যায় ডান কানটা। গলার পোড়া জায়গা কুঁচকে যাওয়ায় স্মরণী এখন ভালোভাবে ঘাড় নাড়তে পারেন না। মাথা উঁচু-নিচু করতেও কষ্ট হয়। এটুকু চিকিত্সাতেই বাবা খাইরুল আলমের সব টাকা ফুরিয়ে যায়। স্মরণীর চিকিত্সার খরচ জোগাতে এগিয়ে আসে এসিড সারভাইভরস ফাউন্ডেশন ও রাসেল নামে এক প্রবাসী যুবক। দুঃসহ যন্ত্রণা আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে স্মরণী মন দেন লেখাপড়ায়। ২০০২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হন। কিন্তু বাবার অর্থসংকটের কারণে স্মরণীর পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হলে পাশে দাঁড়ায় প্রথম আলো সহায়ক তহবিল। কলেজে ভর্তি ও বই-খাতা কেনার জন্য তাকে দেওয়া হয় ৩ হাজার টাকা। সঙ্গে দেওয়া হয় শিক্ষাবৃত্তি। পড়াশোনার জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল থেকে প্রতিমাসে তাকে দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার টাকা। স্মরণী ভর্তি হন নতুন উপশহর মহিলা কলেজে। কিন্তু শারীরিক সমস্যার জন্য এইচএসসি পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয়নি। তবে আত্মপ্রত্যয়ী স্মরণী হাল ছাড়েননি। যখন আবার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি শেষ, তখন এক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিনি। হাতের কনুইয়ের ওপরের হাড় ভেঙে যায়। কব্জির স্নায়ুর মধ্যে ঢুকে যায় আরেকটি ভাঙা হাড়। সেই হাতটি এখন ভালোভাবে নাড়তে পারেন না। সম্প্রতি তার আরও একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। এমন অবস্থায় এবারও স্মরণীর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এত দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনা কিন্তু স্মরণীকে দমাতে পারেনি। এসবের ভেতরেই তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে নিয়েছেন সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিখেছেন কম্পিউটার চালানো। নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা না পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার এই প্রত্যয়ের সঙ্গে এসে দাঁড়ান সাংবাদিক সিকদার খালেদ ও তার পরিবার। গত বছর ২৫ মার্চ স্মরণী ও খালেদ বিয়ে করেছেন। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে খালেদের সঙ্গে স্মরণীর পরিচয় হয়। শ্বশুরবাড়ির সবাই স্মরণীকে খুব আদরের সঙ্গে গ্রহণ করেন। সেখানে থেকে স্মরণী এগিয়ে যাওয়ার আরও প্রেরণা পান। স্মরণীর বাবা খাইরুল আলম ক্ষুব্ধ। কারণ এসিড ছোড়ার দায়ে অভিযুক্ত সোহেলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও সে আজও ধরা পড়েনি। স্মরণী বলেন, ‘সেই পোড়া ক্ষত এখনো আছে। ক্ষতের কথা যখন মনে পড়ে, তখনই চোখে ভেসে ওঠে সেই বীভত্স স্মৃতি। তবু আমি লেখাপড়াটা চালিয়ে যাব।’