'অদ্বিতীয়া' তিন শিক্ষার্থীর গল্প

পরিবারের প্রথম নারী, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌঁছেছেন, এ রকম ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রতিবছর অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রথম আলো ট্রাস্ট। এই কার্যক্রমের আওতায় ২০১২ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) সঙ্গে প্রথম আলোর একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বর্তমানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় এইউডব্লিউর ১৬ জন ছাত্রীকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। বৃত্তিপ্রাপ্ত ৩ শিক্ষার্থী জানালেন তাঁদের সংগ্রামের গল্প।

স্কুলজীবন থেকে টিউশনি করতাম

জাহিদা আক্তার
জাহিদা আক্তার

এইউডব্লিউর প্রি–ইউনিভার্সিটি ক্লাসের প্রথম দিন খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমাকে যখন পুরো ক্লাসের সামনে নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে বলা হলো, কিছুই মুখে আসছিল না। অথচ নিজের সম্পর্কে কত কী বলার ছিল আমার।

আমি বরিশালের ছয়গ্রামে বড় হয়েছি। বাবা কৃষিকাজ করেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কারণে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকে আমি টিউশনি শুরু করি। এসএসসির টেস্ট পরীক্ষার আগে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একদিকে আমার পড়ার চাপ, অন্যদিকে টিউশনি, বাড়িতে বাজার নেই...খুব কঠিন সময় গেছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর তো ভেবেছিলাম, আর পড়ালেখা হবে না। আমার বিয়েও প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তবে আমার পরিবার কখনোই জোর করে আমার ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি।

এখন এইউডব্লিউর পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি। ক্লাসে সবার সামনে কথা বলতে আর ভয় পাই না। নানা দেশের মেয়েদের সঙ্গে ক্লাস করি, খুব ভালো লাগে। প্রথম আলোর দেওয়া বৃত্তি আমাকে আরও সাহস জোগায়।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, পড়ালেখা ছাড়ব না

মোহিনী আফরোজ
মোহিনী আফরোজ

রংপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে পড়েছি। কলেজ ছিল টেপামধুপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। আমার বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীরা যেমন সব বিষয়েই প্রাইভেট পড়ে, আমি তেমন সুযোগ পাইনি। এসএসসিতে পেলাম এ, এইচএসসিতে এ মাইনাস। এরপর আমাকে পড়ালেখা করানোর মতো আর্থিক অবস্থা বাড়িতে ছিল না। আমরা ৩ বোন ১ ভাই। আমি সবার বড়। আমার পেছনে এত খরচ করা তো মানায় না।

অতএব উচ্চমাধ্যমিকের পর আমি চট্টগ্রামে এসে পোশাক কারখানায় কাজ নিই। তবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, বিরতি পড়ে গেলেও পড়ালেখা আমি ছাড়ব না। টাকা জমাচ্ছিলাম আবার পড়া শুরু করব বলে। এর মধ্যে এইউডব্লিউর খবর পেলাম।

এখন আমি প্রি-অ্যাকসেস প্রোগ্রামে আছি। আমরা যারা বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করেছি, একটু পিছিয়ে আছি, তাদের জন্য এই প্রি–অ্যাকসেস প্রোগ্রাম। এখন যেহেতু আমার কোনো আয় নেই, তাই প্রথম আলোর বৃত্তিটা পাওয়ায় খুব সুবিধা হচ্ছে। অন্তত আমার হাতখরচ নিয়ে বাসার মানুষকে ভাবতে হচ্ছে না।

স্বাধীন, সচ্ছল, সফল হতে চাই

সামিনা জামান
সামিনা জামান

আমি চট্টগ্রামের মেয়ে। রাউজানে আমাদের গ্রামের নাম বড়ঠাকুরপাড়া। আমাদের এখানে সবাই মনে করে, মেয়েদের উচ্চশিক্ষা মানেই হলো ডাক্তারি পড়া। মেয়ে যদি ডাক্তার হতে চায়, তাহলে সে কলেজের পরও পড়ালেখা করতে পারে। ডাক্তার না হলে এত পড়ে কী লাভ, কয়েক দিন পর তো বিয়েই করতে হবে! এমনটাই লোকে ভাবে।

বাবা মারা গেছেন ২০০৪ সালে। এরপর পড়াশোনার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের কথা আমি জানতাম। তাই শুরু থেকেই ইচ্ছে ছিল, এখানে পড়ব। এখানে আসার পর বুঝেছি, পড়ালেখার নিয়ম আসলে কেমন হওয়া উচিত। এইউডব্লিউতে কেউ মুখস্থ করতে বলে না। আমার ওপর কিছু চাপিয়ে দেয় না। ক্লাসে অধ্যাপকেরা সব সময় আমার মতামতকে গুরুত্ব দেন। এটাই ভালো লাগে। পড়ালেখা শেষ করে কী হব, সেটা এখনো ঠিক করিনি। তবে এটুকু জানি, আমি একজন স্বাধীন, সচ্ছল, সফল মানুষ হতে চাই।

এক বছরের অ্যাকসেস প্রোগ্রাম শেষ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। ১৮টা দেশের মেয়েরা আমার সহপাঠী। বিদেশিরা যে এত আন্তরিক, সেটা আমি আগে জানতাম না। সাহায্য করার জন্য ওরা সব সময় এগিয়ে থাকে।

‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই’

আরিফ খান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, আইডিএলসি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিজিং কোম্পানি)
আরিফ খান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, আইডিএলসি (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিজিং কোম্পানি)

স্বপ্ন নিয়ে: কেন আপনারা এইউডব্লিউর এই মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন? শুধুই কি করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব), নাকি এর বাইরে আরও কোনো ভাবনা আছে?

আরিফ খান: শুধু ‘করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’ নয়; বরং নারীশিক্ষা প্রসারে সহযোগিতার মাধ্যমে নারী উন্নয়ন তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রগামী ভূমিকা রাখাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা বিশ্বাস করি, নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া দেশের উন্নয়ন এবং জাতির অগ্রগতি কোনোটাই সম্পূর্ণ হয় না। বিগত কয়েক বছর এ ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য এসেছে। তবে এখনো অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। প্রায় ৩৮ শতাংশ মেয়েশিশু শিক্ষাজীবন থেকে এখনো ঝরে পড়ে। এদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

স্বপ্ন নিয়ে: আপনারা যেমন শিক্ষাজীবনে তরুণদের সহায়তা করছেন, চাকরির ক্ষেত্রেও কি তরুণেরা বা ফ্রেশাররা আইডিএলসিতে সুযোগ পান?

আরিফ খান: অবশ্যই। আইডিএলসি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা এবং তরুণদের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তরুণেরা শুধু আইডিএলসিতে চাকরির সুযোগই পায় তা নয় বরং তাদের ক্যারিয়ার জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করতে আমরা তাদেরকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিই। তরুণদের অগ্রগামী চিন্তাভাবনাকে আমরা স্বাগত জানাই।

স্বপ্ন নিয়ে: শিক্ষার্থীদের জন্য আরও কিছু করার পরিকল্পনা কি আপনাদের আছে?

আরিফ খান: আইডিএলসি অনেক দিন ধরেই শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে আসছে। এইউডব্লিউর শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া ছাড়াও দেশজুড়ে বিভিন্ন স্কুলে আমরা স্কুলভবন সংস্কার ও নতুন ক্লাসরুম নির্মাণ করেছি। দেশে প্রথমবারের মতো আমরা অনলাইন ফাইন্যান্স অলিম্পিয়াড করছি। ভবিষ্যতেও আমাদের এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করব।

সূত্র: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ স্বপ্ননিয়ে পাতায় প্রকাশিত।