চরের নাম প্রথম আলো

কুড়িগ্রামে প্রথম আলোর চরে আলোর পাঠশালা। সাম্প্রতিক ছবি।  প্রথম আলো
কুড়িগ্রামে প্রথম আলোর চরে আলোর পাঠশালা। সাম্প্রতিক ছবি। প্রথম আলো

দুধকুমার নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে ওপারে চকচক করছে সারি সারি টিনের চালা। ঘাটে অপেক্ষমাণ মাঝিদের কাছে ইচ্ছে করেই জানতে চাই, ওটা কোন চর বাহে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে—প্রথম আলোর চর।

এটি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের রসুলপুর মৌজায়। ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে ২৫ বছর আগে জেগে ওঠে এই চরটি। দৈর্ঘ্যে ২ কিলোমিটার, প্রস্থে ১ কিলোমিটার। কুড়িগ্রাম শহর থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। পাশেই ভারতের আসাম।

চরের ভেতরে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। সাদা ফুলের মধ্যে সবুজের ছড়াছড়ি। টিনের চালার ওপর লাউ, চালকুমড়া, শিম। বাড়ির পাশেই নানা শাকসবজির খেত। এসবই প্রথম আলোর চরের আজকের চিত্র।

প্রথম দিকে চরটি ছিল ধু ধু বালুচর। ২০০২ সালে বন্যায় বরুয়া, রলাকাটা, কালীর আলগা, ঝুনকার চরে মানুষের বসতভিটা ভেঙে গেলে এ চরে কাশিয়া কেটে বাড়ি তৈরি করে তারা। চরে প্রথম বসতি স্থাপন করে শিক্ষক মোক্তার আহাম্মেদসহ ১৬টি পরিবার। এরপর প্রতিবছর বিভিন্ন চরে ভাঙন শুরু হলে অসহায় পরিবারগুলো এই চরে এসে বসতি গড়ে তোলে। বর্তমানে এখানে প্রায় সাড়ে ৩০০ পরিবারের প্রায় ১ হাজার ৮০০ মানুষ বসবাস করে।

যেভাবে নাম হলো প্রথম আলোর চর

২০০২ সালে এই প্রতিবেদক ও বন্ধুসভার সদস্যরা চরের বন্যাদুর্গতদের ১৬টি পরিবারকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসেন। পানি কমে গেলে প্রথম আলোর দুর্গত তহবিল থেকে ভিটাগুলো উঁচু করে টিনের ঘর করে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে ‘কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা’র ছেলেমেয়েরা চরবাসীর আরও কাছাকাছি চলে আসেন।

২০০৪ সালের ১৫ নভেম্বর ঈদুল আজহার দিন বন্ধুসভার উদ্যোগে চরে গরু কোরবানি দেওয়ার সময় শিক্ষক মোক্তার আহাম্মেদের বাড়ির সামনে চরবাসী হাজির। মোক্তার আহাম্মেদের ছেলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এই চরে বাস করি, কিন্তু নাম নেই। প্রথম আলো বন্ধুসভার ছেলেমেয়েরা আমাদের সুখে–দুঃখে সব সময় পাশে দাঁড়ান। আমরা আজ থেকে চরের নাম দিলাম প্রথম আলোর চর।’ সমস্বরে চিৎকার ওঠে ‘প্রথম আলোর চর, প্রথম আলোর চর’। সেই থেকে শুরু।

চরের প্রতিটি বাড়িতে ছিল খড়ের চালা। নদীর পানি খেত আর খোলা স্থানে পায়খানা করত। রোগবালাই ছিল নিত্যসঙ্গী। পরিবার পরিকল্পনার বালাই ছিল না। কয়েক দফা বৈঠক করে এসব বিষয়ে চরবাসীকে সচেতন করা হয়। স্থানীয় এনজিও ‘জীবিকা’র সহায়তায় চরে প্রতিটি বাড়ির ভিটা ৫ ফুট উঁচু করে টিনের ঘর করে দেওয়া হয়। বিশুদ্ধ পানির জন্য দেওয়া হয় পাঁচটি টিউবওয়েল।

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

চরে কোনো স্কুল ছিল না। ২০০৫ সালে স্থানীয়ভাবে প্রথম আলোর সহায়তায় একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আউয়ালসহ স্থানীয় কয়েকজনের দান করা জমিতে তৈরি করা খড়ের চালার নিচে ১৬টি শিশু নিয়ে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। শিক্ষকেরা বেতন পেতেন না। ২০১০ সালে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ওই জমিতে গড়ে ওঠে প্রথম আলোর চর আলোর পাঠশালা নামের বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে পাকা মেঝে ও টিনের চালার ভবন রয়েছে তিনটি। বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৯০ জন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে। শিক্ষকের সংখ্যা ৯ জন। বিদ্যালয় সহকারী একজন। যাবতীয় খরচ বহন করছে ট্রাস্ট। সহযোগিতা করে সামিট গ্রুপ।