'প্রথম আলো পাশে আছে এ মনোবলেই ঘুরে দাঁড়াই'

অ্যাসিডদগ্ধ রত্না মণ্ডল এখন ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা কর্মকর্তা। প্রথম আলোর সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি।  ছবি: সংগৃহীত
অ্যাসিডদগ্ধ রত্না মণ্ডল এখন ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা কর্মকর্তা। প্রথম আলোর সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচির মানিকগঞ্জ অফিসে নির্যাতনের শিকার মানুষের অভিযোগ শোনেন এবং সমাধানে সহায়তা দেন কর্মকর্তা রত্না মণ্ডল। গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি এখানে যোগ দেন।

ঝিনাইদহের এই রত্না মণ্ডল ১৯৯৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় অ্যাসিড–সন্ত্রাসের শিকার হন। বাবার প্রতিপক্ষ তাঁকে জব্দ করতে স্কুলপড়ুয়া মেয়েটিকে বেছে নেয়। সেই রত্না ১৯ বছর ধরে আস্তে আস্তে নিজেকে নির্মাণ করে আজকের অবস্থানে এসেছেন।

‘এখনো কোনো কারণে মনটা দুর্বল হলে ভাবি প্রথম আলো পাশে আছে। এতে নিজের ভেতরে একটা শক্তি অনুভব করি, আর এ মনোবলেই ঘুরে দাঁড়াই।’ এ কথা বলার পাশাপাশি সেই দুর্বিষহ দিনের কথাও স্মরণ করলেন রত্না মণ্ডল, ‘তখন আমার পাশে প্রথম আলো না দাঁড়ালে হয়তো আত্মহননের পথেই চলে যেতাম। মানসিক অবস্থা তখন এমনই ছিল।’

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অ্যাসিডদগ্ধ রত্না মণ্ডলকে প্রথমে একটি দোকান করে দেওয়া হয়। এর আয় দিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যান তিনি। মাস্টার্সে পড়ার সময় আবার মাসিক বৃত্তি, বই কেনার জন্য আর্থিক সহায়তা পান প্রথম আলো থেকে। রত্না প্রথম আলোর পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে ব্র্যাক এবং অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) প্রতিও। কারণ, প্রথম আলোর পাশাপাশি এএসএফ, ব্র্যাক, অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ, ব্র্যাক ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনও যুক্ত হয়ে পড়ে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে।

দেশে ২০০০ সালে অ্যাসিড–সন্ত্রাস ভয়াবহ আকার ধারণ করে। প্রথম আলো সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি এসব মেয়ের পুনর্বাসনে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম আলোর কর্মীদের সে সময়ের এক দিনের বেতন ৩২ হাজার টাকা দিয়েই যাত্রা শুরু করে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল। এ পর্যন্ত প্রথম আলো সহায়ক তহবিল থেকে ৪৫৬ জন নারী সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৩০২ জনকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, সৌন্দর্য প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহায়তা, মাসিক ভাতা, আইনি সহায়তাসহ বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছে প্রথম আলো

প্রথম আলোর এই উদ্যোগে পাঠক, শুভানুধ্যায়ীসহ বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি যুক্ত হতে থাকে। সরকারও এগিয়ে আসে। ২০০২ সালে অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ ও অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন নামে দুটি আইন প্রণীত হয়। আর এত সব কর্মযজ্ঞের ফলে দেশে অ্যাসিড–সন্ত্রাস কমতে শুরু করে। ২০০০ সালে সারা দেশে অ্যাসিডদগ্ধ হয়েছিলেন ২৪০ জন, আর গত বছর তা কমে নেমে এসেছে ৪৭ জনে। চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২২ জন।

২০০৪ সালের ২২ জানুয়ারি কিশোরী হাসিনা আখতার অ্যাসিডদগ্ধ হন। তাঁর একটি চোখ ও কান নষ্ট হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ৮ মার্চ প্রথম আলোর বিশেষ ক্রোড়পত্রে হাসিনার জীবনের কাহিনি ছাপা হয়। চোখে পড়ে তখনকার পুলিশের মহাপরিদর্শকের। তিনি আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। নারায়ণগঞ্জ পুলিশ পরদিন ৯ মার্চ দুপুরের মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার করে। প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান হাসিনা। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই আসামি এখন কারাগারে আছেন।

অ্যাসিড নিক্ষেপকারীদের শতকরা ৯৯ জনই পুরুষ। তাই পুরুষদের সচেতন না করলে এ সন্ত্রাস বন্ধ করা কঠিন। এ উপলব্ধি থেকে ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পুরুষদের র‍্যালির আয়োজন করে প্রথম আলো, এএসএফ এবং ব্র্যাক।

অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য হংকংয়ের ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব প্রথম আলোকে দ্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাওয়ার্ড–২০১০ প্রদান করে। প্রথম আলো ট্রাস্ট অ্যাসিড–সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ অব্যাহত রেখেছে।