মাদকের অন্ধকার থেকে আলোর পথে

প্রথম আলো ট্রাস্টের আয়োজনে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভায় কথা বলেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা। ছবি: অধুনা
প্রথম আলো ট্রাস্টের আয়োজনে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভায় কথা বলেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা। ছবি: অধুনা

বৈশাখের রোদতপ্ত অন্য দিনগুলোর মতোই ছিল ১৭ এপ্রিল। বিকেলটাও তেমন। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটার ছোঁয়ার আগেই ঢাকার ধানমন্ডির উইমেনস ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশনে (ডব্লিউভিএ) একে একে হাজির হতে থাকে বিষণ্ন মনের মানুষেরা। কেউ এসেছে বাবার সঙ্গে, কেউবা এসেছে বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। মা–বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে অনেকে। কয়েকজন এসেছে একা। তবে যে যার সঙ্গেই আসুক না কেন, সবার আসার উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা। মাদকাসক্ত ও তাদের প্রিয়জন যারা মাদক ছাড়তে ইচ্ছুক, তাদের নিয়ে ঘরোয়া এ আয়োজনে আগত ব্যক্তিদের নাম পরিচয় গোপন রাখা হয় এখানে। আয়োজনটি ছিল ১০৪তম পর্ব। প্রতি মাসে এমন আয়োজন হয়।

সবার স্বপ্নই এক 

পরিবারের সবার চোখের মণি। পড়াশোনায় বেশ ভালো। ২০০২–০৩ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ভর্তি হন শাকিল আহমেদ (ছদ্মনাম)। কিন্তু স্বপ্নের ক্যাম্পাসে তাঁর স্বপ্ন দূরে চলে যেতে থাকে। ভর্তির পরেই তাঁর ভালোবাসার মানুষ তাঁকে ছেড়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ে চলে যায়। বিষণ্নতায় পেয়ে বসে শাকিলকে। কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে এগিয়ে আসে হলের কয়েকজন বড় ভাই। কষ্ট থেকে মুক্তি ‘বটিকা’ তাঁর হাতে ধরিয়ে দেন। মুক্ত এই বটিকার পোশাকি নাম ক্যানাবিস একজনের কষ্টের দূর করতে পারলেও পরিবার, বন্ধুবান্ধবের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তত দিনে তিনি আসক্ত হয়ে পড়েছেন নেশায়। পরীক্ষায় খারাপ ফল। ‘আমি সারা দিন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। আমি কোনোভাবেই পরীক্ষায় পাস করতে পারছিলাম না। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি।’

সব বন্ধুরা যখন একে একে পাস করে পরিবার, ভালো চাকরি শুরু করে, তখন বোধোদয় হয় শাকিলের। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন থেকে একদিন চলে আসেন প্রথম আলোর মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভায়। ‘এখন আমি অনেক ভালো আছি। চাকরির চেষ্টা করছি। চাকরি পেলেই পরিবারের পছন্দমতো বিয়ে করব।’ মুচকি হাসিতে এমনটাই জানান দেন শাকিল আহমেদ।

পুরান ঢাকা ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান মনোয়ার হোসেন (ছদ্মনাম)। অল্প বয়সেই পারিবারিক ব্যবসা চালের আড়তে বাবার পাশাপাশি দেখভালের দায়িত্ব এসে চাপে কাঁধে। সন্তানের মাদকাসক্ত হওয়ার পরের গল্পটি বাবার মুখে শুনি। ‘চালের আড়তে দায়িত্ব নেওয়ার ফলে ওর (মনোয়ার হোসেন) হাতে অনেক টাকা চলে আসে। টাকার লোভে অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক খারাপ বন্ধু জুটে যায়। তাদের পাল্লায় পড়ে আমার ভালো ছেলেটি অন্ধকার জগতে চলে যায়। আমরা কিছু করতে পারি নাই।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবার সরল স্বীকারোক্তি। মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য বিয়ে করানো হয়। ঝাড়ফুঁকসহ অনেক কিছু করানো হয়। কিন্তু কোনো কিছুই কিছু হয় না। অবশেষে আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা পায় মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা।

সূত্র: ২৪ এপ্রিল ২০১৯, অধুনা’তে ছাপা হয়েছে।

চলছে পরামর্শ প্রদান
চলছে পরামর্শ প্রদান

ননদের ছেলে ঢাকার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। থাকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই একটি বাসা ভাড়া করে। মাঝেমধ্যে মামার বাসায় বেড়াতে আসে। একা থাকার ফলে অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। সমবয়সী মামাতো ভাই থাকার কারণে ধানমন্ডিতে অবস্থিত মামার বাসায় মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসে। কিন্তু মামির সন্দেহ হয় তার নিজের সন্তানটিও ওর কারণে (ননদের ছেলে) আস্তে আস্তে মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। সাদা চোখে তার কিছু নমুনাও পাচ্ছেন তাঁরা। কী নমুনা দেখা গেলে তাঁর সন্তান মাদকাসক্ত, সেটা জানতেই এ আয়োজনে এসেছেন স্বামী–স্ত্রী দুজন।

প্রথম আলোর মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা কর্মশালার ১০৩ পর্বে প্রথম এসেছিলেন সিলেট নিবাসী স্বামী–স্ত্রী। এবার এলেন দ্বিতীয়বারের মতো। পরামর্শ সহায়তা আসার কারণ জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘আমাদের সন্তান নানা–নানির কাছে ঢাকায় থাকে। ২০১৭ সালে ও লেভেল পরীক্ষার আগে একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়। প্রেমের কারণেই ছেলে খারাপ পথে চলে যায়। কীভাবে আবার তাকে ভালো পথে নিয়ে আসা যাবে, সেটা জানতেই এসেছেন এখানে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই আলাদাভাবে পরামর্শ নিয়ে আসা আগত মানুষের কথা শোনেন মনোরোগ চিকিৎসক মেখলা সরকার, মো. রাহেনুল ইসলাম, মো. জোবায়ের মিয়া ও ফাতিমা মারিয়া খান। এই চারজন মনোরোগ চিকিৎসক তাঁদের কথা শুনে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। এরপর শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান এতে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, প্রথম আলো ট্রাস্টের আয়োজনে প্রতি মাসে ডব্লিউভিএ মিলনায়তনের অনুষ্ঠিত হয় মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা। এ আয়োজনে এসে সহায়তা নিয়ে অনেক স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। মাদক গ্রহণ কোনো সমাধান নয়। ভালো থাকতে হলে মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে।