ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এখন ওরা স্বপ্নপূরণের পথে

মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি পাচ্ছে ২০ শিক্ষার্থী।  

মতবিনিময় সম্মিলনে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা। ছবি: প্রথম আলো।
মতবিনিময় সম্মিলনে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীরা। ছবি: প্রথম আলো।

দিনমজুর বাবা আর পোশাকশ্রমিক মায়ের উপার্জনে চলছিল মাহিয়ার পড়ালেখা। রানা প্লাজা ধসে মাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারটি। বন্ধ হয়ে যায় চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিয়ার স্কুলে যাওয়া। তবে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে সে এখন দশম শ্রেণিতে পড়ছে। মাহিয়া আক্তারের সঙ্গে গতকাল শনিবার কথা হয় প্রথম আলোর কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে। তার স্বপ্ন, সে ভালো মানুষ হবে।

রানা প্লাজার একটি কারখানায় কাজ করতেন কুমিল্লার ইয়াকুব আলী। ওই দুর্ঘটনায় তাঁর ডান হাত, ডান পা এবং ডান পাশের পাঁজর ভেঙে যায়। শারীরিক জটিলতায় কাজ করতে পারেন না। তবে মেরিল-প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিলের অনুদানে তিনি একটি মুদিদোকান দিয়েছেন। ইয়াকুব বলেন, ‘গত ছয় বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। কী অবস্থায় আছি কেউ জানতেও চায়নি। এই অনুদান পেয়ে আমরা কৃতজ্ঞ।’

ছয় বছর আগের ২৪ এপ্রিলে রানা প্লাজা ভবন ধসে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৮ জন। ওই দুর্ঘটনা হাজারো পরিবারের দুর্যোগের কারণ। কিন্তু পরিবারগুলো একটু সহায়তা পেলে যে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তার প্রমাণ মেরিল-প্রথম আলো সাভার তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি ও অনুদান। রানা প্লাজা ধসের দুদিন পর এই তহবিল গঠিত হয়। তহবিল পরিচালনা করছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। গতকাল ‘ঘুরে দাঁড়ানোর ৬ বছর’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল মাহিয়াসহ রানা প্লাজায় নিহত ও আহত ২০ জনের সন্তানেরা। এই ২০ শিক্ষার্থী ও আহত ১০ জন গতকালের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

রানা প্লাজা ধসে মা হারানোর দুঃসহ স্মৃতির কথা বলেছে মাহিয়া। গতকাল কারওয়ান বাজারের সিএ  ভবনে। ছবি: প্রথম আলো।
রানা প্লাজা ধসে মা হারানোর দুঃসহ স্মৃতির কথা বলেছে মাহিয়া। গতকাল কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে। ছবি: প্রথম আলো।

অনুষ্ঠান শুরুই হয় মাহিয়ার গানে। সে গেয়ে শোনায়, ‘মাগো তোমার মতো লয় না কেউ আমায় বুকে টানি, আঁচল দিয়ে মুছে না কেউ আমার চোখের পানি’। এ সময় সৃষ্টি হয় অশ্রুসজল এক মুহূর্তের। মাহিয়া এরপর বলে, ‘মাকে আমি কখনো ফিরে পাব না। কিন্তু আমি অনেক পড়ালেখা করতে চাই। ভালো মানুষ হতে চাই। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’

রানা প্লাজায় একটি পোশাক কারখানায় কোয়ালিটি পরিদর্শক হিসেবে কাজ করতেন ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল আমিন। তাঁর বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জে। ওই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এই তহবিলের শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে আল আমিন সদ্য মাস্টার্স পাস করেছেন। এখন চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন। আল আমিন বলেন, ‘এই বৃত্তি আমাকে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছে। টাকার অভাবে আমি পড়ালেখা ছেড়েই দিতাম। এখন লেখাপড়া শেষে আমি নিজের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করছি।’

ভবনধসে গুরুতর আহতদের মধ্য থেকে পুনর্বাসনের জন্য ১০০ জনের প্রত্যেককে দেওয়া হয় ১ লাখ টাকা করে। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় সাবিনার ডান পাঁজরের হাড় ভেঙেছিল। কর্মক্ষম সাবিনা আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। এখনো তাঁকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে দুঃসহ স্মৃতি ও শারীরিক জটিলতা। নিরুপায় সাবিনাকে দেওয়া হয় অনুদান। সেই টাকা দিয়ে সাবিনা জমি বর্গা নেন। বর্গা জমির ধান বিক্রি করা টাকা এখন তিনি পরিবারকে দিচ্ছেন। সাবিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সহযোগিতা না পেলে আমি ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতাম।’

তহবিলের আওতায় প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত শিক্ষাবৃত্তির সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বৃত্তি পাওয়াদের মধ্যে যেমন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আছে, তেমনই আছেন স্নাতকপড়ুয়া শিক্ষার্থীও। তাদের কেউ হতে চায় চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, কেউ-বা হতে চায় খেলোয়াড়। পাবনার বাদাল বীণাপাণি এসসি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বলে, ‘কখনো ভাবতে পারিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। এবার আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আরও পড়ালেখা করতে চাই।’

 সূত্র: ৫ মে ২০১৯ প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে।