এনামুল হক যখন তার জীবনযুদ্ধের কথা বলছিল, তখন মিলনায়তনজুড়ে পিনপতন নীরবতা। অনেকের চোখ ছলছল করছিল। তিন বছর বয়সে বাবাকে হারায় সে। অসহায় মা এনামুলকে কোলে আঁকড়ে কাজের সন্ধানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থেকে গাজীপুরের টঙ্গীতে আসেন। মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ নেন মা। টঙ্গীতেই স্কুলে ভর্তি হয় এনামুল। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে জিপিএ-৫ পায়। অভাব তখনো পিছু ছাড়েনি। বাধ্য হয়ে সে মানুষের দোকানে কাজ নেয়। সমবয়সীদের স্কুলে যেতে দেখে কষ্ট হতো খুব। একপর্যায়ে পড়ার জন্য গ্রামে খালার বাড়িতে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানেও ছিল নানা প্রতিকূলতা। খাতায় একবার লিখে পেনসিল দিয়ে সে লেখা মুছে আবার সেই খাতায়ই লিখত। এত কষ্টের পরও থামেনি এনামুল। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ক্লাসে প্রথম হতো সে। এসএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়ে এখন সে ঢাকার উত্তরার একটি কলেজে পড়ছে। তবে এখন আর পড়ালেখার জন্য আর্থিক সমস্যা নেই তার। কারণ, তার পাশে দাঁড়িয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে আয়োজিত অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এনামুলের মতো আরও কয়েকজন তাদের জীবনের গল্প শোনায়। অদম্য মেধাবীর বৃত্তি পাওয়া সুনামগঞ্জের ধরমপাশার জেলে পরিবারের মেয়ে মুক্তা দাসের কথাগুলো মনে দাগ কেটে যায়।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি পেয়ে স্নাতক পাস করা ৪৩ জনকে ক্রেস্ট, এইচএসসির পর স্নাতক পর্যায়েও বৃত্তি পেতে যাওয়া ২৭ জনকে মেডেল ও এসএসসির পর এইচএসসিতে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত ৭১ জনকে উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে এনামুল, মুক্তা দাস ছাড়াও অনুষ্ঠানে নিজেদের কথা তুলে ধরে চট্টগ্রামের পটিয়ার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মো. সাইফুদ্দিন রাফি, কক্সবাজারের মহেশখালীর শাহিন সুলতানা, কক্সবাজারের পারভেজ মোশারফ, রংপুরের জান্নাতুল ফেরদৌসী।
ব্র্যাক ব্যাংকের একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। এরপর প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় পরিচালিত রাজশাহীর পদ্মাপারের চর খিদিরপুরের আলোর পাঠশালা নিয়ে তৈরি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ গানের সঙ্গে একটি দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে ভাবনা নৃত্য দল।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম অদম্য মেধাবী বৃত্তির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৯৪২ জনকে এই বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ব্র্যাক ব্যাংকের অন্যতম ভিশন হচ্ছে আলোকিত বাংলাদেশ গড়ায় ভূমিকা রাখা। অদম্য মেধাবীরা আলোকিত বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করছেন।
অদম্য মেধাবীদের উৎসাহ দিতে এসেছিল ঢাকার ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় সানিডেইল, স্কলাসটিকা, ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুল, সাউথ ব্রিজ, স্যার জন উইলসনের বেশ কিছু শিক্ষার্থী।
অদম্য মেধাবী বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসক হওয়া মাসুদ রানা তাঁদের মতো অদম্য মেধাবীদের সহায়তা ও সাহস দেওয়ার জন্য প্রথম আলো ট্রাস্টকে ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রায় ১০০ বছর আগে তাঁর কৃষক পরিবারের বাবা কীভাবে সকালে গরু চরিয়ে ও বাজারে দুধ বেচে পড়াশোনা করতেন এবং মাধ্যমিকে মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছিলেন, সেই কথা তুলে ধরেন। অদম্য মেধাবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গ্রামকে, সমাজকে ভুলে যাওয়া যাবে না।
সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ট্রাস্টি পারভীন হাসান বলেন, বাইরের কেউ যদি সহায়তার হাত ধরে, তাহলে অদম্য মেধাবীদের পথচলার চেষ্টা সহজ হয়ে যায়। সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এন এম মেশকাত উদ্দিন বলেন, ‘যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথম আলো। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখলাম আজ।’
এ ধরনের কাজে সরকারি সহায়তার প্রতি মুখাপেক্ষী না হয়ে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন আইইউবিএটির উপাচার্য আবদুর রব।
অনুভূতি ব্যক্ত করেন ব্যক্তিগতভাবে ১০ জন অদম্য শিক্ষার্থীকে সহায়তা দেওয়া চিকিৎসক শিরিন আখতার।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই। সমগ্র ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে চলেছে। এ ধরনের অদম্য মেধাবী, যারা দরিদ্র, নিগৃহীত, সবচেয়ে বেশি অধিকারবঞ্চিত, তারা যখন জেগে ওঠে, তারা যখন সামনে এগিয়ে যাবে, তখন সত্যিকার অর্থে বলব বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে।’
অনুষ্ঠানে অদম্য মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়ার জন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সানিডেইলের পক্ষ থেকে উপাধ্যক্ষ জেবুন্নেছা মাহমুদ ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার চেক তুলে দেন।
প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ জামান চৌধুরীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন চিত্রনায়ক সিয়াম আহমেদ, ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফীস, টেন মিনিট স্কুলের উদ্যোক্তা আয়মান সাদিক, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আজিজা আহমেদ প্রমুখ।
সূত্র: প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছে ৪ অক্টোবর, ২০১৯