মাদককে 'না' বলুন

প্রথম আলো ট্রাস্ট নিয়মিত আয়োজন করে মাদকবিরোধী কনসার্ট। ১৭ জুলাই, ২০১০
প্রথম আলো ট্রাস্ট নিয়মিত আয়োজন করে মাদকবিরোধী কনসার্ট। ১৭ জুলাই, ২০১০

প্রথম আলোয় যোগ দেওয়ার পর দ্বিতীয় দিন। চেয়ারে বসে কাজ করার সময় হঠাৎই পেছন থেকে পিঠে চাপড়। মাথা ঘুরিয়ে দেখি স্বয়ং সম্পাদক মতিউর রহমান। যেতে যেতে তর্জনী ওপর-নিচ করে বললেন, ‘মাদক, মাদক, মাদক।’ কিছুটা হতভম্ব আমাকে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীরা জানালেন, মাদকের বিরুদ্ধে লাগতে হবে, প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে—এটাই সম্পাদকের বার্তা। জানলাম প্রথম আলোর মাদকবিরোধী ব্যাপক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে। শুধু সংবাদ প্রকাশই নয়, মাদকবিরোধী প্রচারণা, মাদকের কবল থেকে মাদকসেবীদের মুক্ত করতে নিয়মিত প্রচেষ্টা চলছে।

১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর আত্মপ্রকাশের পর থেকেই প্রথম আলো লেগে আছে মাদকের পেছনে। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে। মাদকচক্র নিয়ে হচ্ছে বিশেষ প্রতিবেদন। অন্য যেকোনো অপরাধের পেছনে মাদক থাকলে সেটিকেও পাঠকের সামনে এনে হাজির করার চেষ্টা থাকে সব সময়।

কেবল সংবাদ প্রকাশই নয়, প্রথম আলো ২০০৩ সালের ১ মে থেকে শুরু করে মাদক বিরোধী আন্দোলন।সে সময়ে গঠিত এই আন্দোলনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন, মুহাম্মদ আজিজ খান, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, জুয়েল আইচ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মুনির আহমেদ খান, ডা. মোহিত কামাল, আনিসুল হক, বিপ্লব, মাহমুদুজ্জামান বাবু, ফেরদৌস আহমেদ, আদিল হোসেন নোবেল, বিপাশা হায়াত, হাবিবুল বাশার, ডা. আহমেদ হেলাল, ডা. খালেদা আকতার, অপি করিম এবং আব্দুন নূর তুষার। কমিটির অন্যতম দুই সদস্য ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল এবং আইয়ুব বাচ্চু এখন প্রয়াত।

২০০৯ সাল থেকে এই মাদকবিরোধী আন্দোলন এখন পরিচালনা করছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। মাদকসেবীদের সহায়তা দিতে প্রথম আলো ট্রাস্ট প্রায় প্রতি মাসে একটি করে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভার আয়োজন করছে। সেখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তি, তাঁদের মা-বাবা ও স্বজনেরা উপস্থিত হচ্ছেন। পরামর্শ দিয়ে আসছেন দেশের নামকরা মনোরোগ চিকিৎসক ও মাদক নিরাময় নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা। প্রথম আলোর পরামর্শ সভায় নিয়মিত অংশ নিয়ে মাদক ছেড়েছেন—এমন ব্যক্তি এখন সভায় উপস্থিত থেকে মাদকাসক্তদের পরামর্শ দেন। একজন মা আগে আসতেন নিজের মাদকাসক্ত ছেলেকে নিয়ে। ছেলে সুস্থ হয়েছে। সেই মা এখন অন্যদের পরামর্শ দিতে সভায় উপস্থিত হন।

মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে বিভিন্ন সময় ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বড় শহরগুলোয় আয়োজন করা হয়েছে মাদকবিরোধী কনসার্ট, যেখানে গান গেয়েছেন দেশের বড় শিল্পীরা। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৭টি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর দেওয়া হচ্ছে মাদকবিরোধী সেরা প্রতিবেদনের পুরস্কার।

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠালগ্নে দেশে মাদক বলতে ছিল ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনের অপব্যবহার। ২০০০ সালের দিকে দেশে ধীরে ধীরে এমফিটামিন-জাতীয় উত্তেজক (এটিএস) মাদক বা ইয়াবার ব্যবহার বাড়তে থাকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে হু হু করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্ধার হওয়া ইয়াবা বড়ির সংখ্যা বছরে প্রায় চার কোটিতে এসে ঠেকেছে। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) মতে, উদ্ধার হওয়া মাদকের এই সংখ্যা মোট বিক্রি হওয়া বড়ির মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা দাম হিসাবে)। এই টাকার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ইয়াবার উৎসভূমি মিয়ানমারে।

মিয়ানমার থেকে মূলত কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে চোরাই পথে আসা ইয়াবা দেশে ঢুকছে। টেকনাফে কারা ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আছে সরকারের সংস্থাগুলোর কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা ধরে ২০১৩ সালে প্রথম আলোয় ছাপা হয় ‘ইয়াবা নিয়ন্ত্রকদের পৃষ্ঠপোষক সাংসদ!’ শীর্ষক প্রতিবেদন। বিভিন্ন সময় সরকারি সংস্থাগুলোর তালিকা ধরে টেকনাফের মাদক ব্যবসায়ীদের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন হয়েছে। এসব নিয়ে দীর্ঘদিন কাজের পর গত বছর থেকে সরকার শুরু করে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান। প্রথম আলোর হিসাবে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে গত ৫০৯ দিনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৪৬৪ জন সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। তবে ২০১৩ সালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে যে সাংসদের নাম ছিল, তিনি এখনো এলাকায় রয়ে গেছেন। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে দেশের সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবা প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করলেও ছোট্ট আকারের এই বড়ি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে

প্রথম আলো ২১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় প্রকাশিত। ৩ নভেম্বর ২০১৯।