এই গল্পগুলো কষ্টের, যন্ত্রণার

২০ বছরের নিয়াজের কাছে বাবা মানেই লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যায় শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরা দুটি হাত। আর গুনগুন গান। ছোট বোন আমিনার অবশ্য বাবার কথা মনে নেই। তবু সে যোগ করে, ‘বাবা খুব ভালো ছবিও আঁকত, না?’ হলদে হয়ে যাওয়া কাগজে বাবার আঁকা নৌকার পাশে সে-ও নিজের মতো একটা নৌকা এঁকেছিল বছর কয়েক আগে। সেটাই দেখাল। 

২১ আগস্টের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে নিহত রতন শিকদারের পরিবার। বাবার ছবি আর ব্যবহার্য জিনিসেই বাবাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর দুই সন্তান l ছবি: হাসান রাজা
২১ আগস্টের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে নিহত রতন শিকদারের পরিবার। বাবার ছবি আর ব্যবহার্য জিনিসেই বাবাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর দুই সন্তান l ছবি: হাসান রাজা

নিয়াজ আর আমিনা ২১ আগস্টের হামলায় নিহত রতন শিকদারের দুই সন্তান। তাঁদের কাছে বাবা মানেই টুকরা টুকরা ছবি। ১৩ বছর ধরে সেই টুকরা স্মৃতি জোড়াতালি দিয়েই তাঁদের জীবন চলছে। যেমন জোড়াতালি দিয়ে চলছে তাঁদের সংসার। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর বেশির ভাগ একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে বেশ কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছে। সহায়তা যা পাচ্ছে, তাতে কোনো রকমে টেনেটুনে চলছে সংসার।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন সাংসদ নাসিমা ফেরদৌসী৷ সেদিনের কথা মনে করে এখনো শিউরে  ওঠেন তিনি l ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন সাংসদ নাসিমা ফেরদৌসী৷ সেদিনের কথা মনে করে এখনো শিউরে ওঠেন তিনি l ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের কর্মী রতন শিকদার ছিলেন রি-রোলিং মিলের ব্যবসায়ী। তবে শেষ দিকে ব্যবসার অবস্থা বেশি ভালো যাচ্ছিল না। ঋণও হয়েছিল কিছু। গত শনিবার দোলাইরপাড়ের দুই কামরার ভাড়া ফ্ল্যাটে কথা হচ্ছিল রতনের স্ত্রী নুসরাত জাহানের সঙ্গে। বললেন, ‘আমাদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারে নাই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় রকম আশা ছিল। কতটুকু করতে পারব, জানি না।’
ভাড়া বাড়ায় দুই দফা বাড়ি পাল্টেছেন নুসরাতরা। এখন দুই সন্তান নিয়াজুল হক আর আমিনা জাহান আব্বাসীকে নিয়ে মায়ের কাছে থাকেন। ভাই সংসার চালাতে সাহায্য করেন। জানালেন, ২০০৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু কল্যাণ ট্রাস্ট মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দেয়। ২০১৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগের দেওয়া ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র থেকে মাসে ১০ হাজারের মতো টাকা আসে। ছেলেমেয়ে দুজনে বেসরকারি কলেজে পড়ছে। তাই সব মিলিয়ে কুলিয়ে ওঠা কষ্ট।
নুসরাত জাহান বললেন, ‘এখন মায়ের সঙ্গে আছি। গ্রামে থাকার জায়গা নাই। শ্বশুরবাড়িরও সাপোর্ট নাই। নেত্রী যদি থাকার একটা জায়গা করে দিতেন, চিরঋণী হয়ে থাকতাম।’
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী নিহত মাহবুবুর রশীদের পরিবারের গল্পটাও প্রায় একই। স্ত্রী শামীমা আক্তার বললেন, ‘টানাটানি করেই চলে।’
সংসার চলছে শামীমার ছোট ভাইয়ের সহায়তায়। দুই ছেলের একজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যজন বেসরকারি মেডিকেলে পড়ছেন। শামীমা বলেন, নেত্রীর সুপারিশে ছোট ছেলের মেডিকেলে পড়ার খরচ লাগছে না। কিন্তু বড় ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা দিতে হয়। ট্রাস্ট আর সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে মাসে ১২ হাজার টাকা আসে। দুর্মূল্যের বাজারে এই টাকায় চলা কষ্ট।

আহত সেলিম চৌধুরী
আহত সেলিম চৌধুরী

মাহবুবুর রশীদ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছেন নিজের জীবন দিয়ে। শামীমা আক্তার বলেন, তখন সবাই খুব বাহবা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বীরের মৃত্যু। কিন্তু সাহায্যের বেলায় দলীয় প্রধান ছাড়া আর কেউ এগিয়ে আসেননি। বললেন, ‘আজ তিন বছর ২১ আগস্টের অনুষ্ঠানে যাই না। আহত-নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সেখানে বসার জায়গা হয় না।’
২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেখ হাসিনার কারাবন্দীর দিনগুলোতে অর্থসাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে শামীমা আর তাঁর ছেলেরা খুব বিপদে পড়েন। ঢাকার বাড়ি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হন। অনিশ্চয়তার সেই ভয় এখনো তাড়া করে। শামীমা বলেন, ‘নদীর মতো ভেসে বেড়াচ্ছি। ঢাকা, নইলে কুষ্টিয়ায়—নেত্রী যদি মাথা রাখার জায়গা দিতেন, দুই ছেলে নিয়ে থাকতাম। আর কোনো আশা নাই।’

নিহত মাহবুবুর রশীদের স্ত্রী শামীমা আক্তার
নিহত মাহবুবুর রশীদের স্ত্রী শামীমা আক্তার

মুগদা এলাকার কৃষক লীগের কর্মী আবুল হোসেনও ছিলেন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সেদিনের সমাবেশে। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার তাঁর মূত্রথলিতে পৌঁছে গিয়েছিল। সংক্রমণ হয়ে ২০১১ সালে মারা যান। দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাতে তাঁর স্ত্রী নাজমা বেগমও হিমশিম খাচ্ছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর সঞ্চয়পত্র আর ট্রাস্ট থেকে মাসে আট হাজার টাকা আসে। নাজমা বেগম বলেন, ‘আমি ছোট চাকরি করি। এই টাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া আর সংসার চলে না। নেত্রী যদি একটু থাকার ব্যবস্থা কইরা দিতেন, খুব ভালো হইত।’

নিহত আবুল হোসেনের স্ত্রী নাজমা বেগম
নিহত আবুল হোসেনের স্ত্রী নাজমা বেগম

আহতদের ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা
২১ আগস্টের সেই গ্রেনেড হামলায় আহত মানুষের সংখ্যা কয়েক শ। ১৩ বছরে স্প্লিন্টারের ক্ষত শুকিয়েছে, কিন্তু ছাপ রেখে গেছে নানাভাবে।
বরগুনার সাংসদ নাসিমা ফেরদৌসী ২০০৪ সালে ছিলেন ঢাকা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। ২১ আগস্ট বিকেলে চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন লাশের ট্রাকে; গাদাগাদি করে রাখা লাশগুলোর সঙ্গে। ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন তিনি।
গ্রেনেড হামলায় নাসিমার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে উড়ে যায়। বাঁ পা আর ডান হাত ভাঙে। দেশে ও দেশের বাইরে তাঁর অনেকবার অস্ত্রোপচার হয়। এখনো সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক স্প্লিন্টার।
সেদিনের কথা মনে করে এখনো শিউরে ওঠেন নাসিমা। বললেন, ‘ডাক্তাররা এক পা কেটে ফেলতে চাইছিলেন। পরে নেত্রী (শেখ হাসিনা) চিকিৎসার জন্য দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রায় তিন মাস থাকতে হয়।’

আহত নিলুফার রহমান
আহত নিলুফার রহমান

শেষ পর্যন্ত নাসিমার পা-টা কাটতে হয়নি। কিন্তু হুইলচেয়ারে বন্দী ছিলেন প্রায় চার বছর। আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে প্রায় ১২ বছর লেগে গেছে। এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। ধরা গলায় নাসিমা বললেন, ‘মিছিলে যাইতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু তাল মিলাইতে পারি না। পিছনে পইড়া থাকি।’
যুবলীগের নেতা সেলিম চৌধুরীর শরীরে ১৯ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। গ্রেনেডের আঘাতে পেট ফেটে অন্ত্র বের হয়ে এসেছিল তাঁর। বাঁ হাত আর ডান পা ভাঙে। বললেন, প্রায় সাত বছর বিছানায় ছিলেন। ভাঙা হাত-পা এখনো কষ্ট দেয়। পায়ের পাতায় থাকা স্প্লিন্টারের জন্য হাঁটতে কষ্ট হয়।
সেদিন আহত হওয়া ঢাকা দক্ষিণ যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক নিলুফার রহমানের শরীরেও জ্বালাপোড়া হয় খুব। ডান পায়ের আঘাত আর শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। তবে আরেকটা কষ্ট তাঁকে পোড়ায়। তাঁর সঙ্গে সেদিন সমাবেশে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন তাঁর ভাড়াটে রংপুরের রেজিয়া বেগম। সেই ঘটনায় এখনো নিজেকে দোষারোপ করেন। নিলুফার বললেন, ‘রেজিয়ার বাপ-মা বিচার দেইখা যাইতে পারে নাই। আমরা দেইখা যাইতে পারব কি না, জানি না।’