টেকনাফ এখন 'রোহিঙ্গা শহর'

শাহপরীর দ্বীপ থেকে ট্রাকে করে টেকনাফ শহরে এসে পৌঁছেছে রোহিঙ্গারা। গতকাল বিকেলে টেকনাফ বাসস্ট্যান্ড থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো
শাহপরীর দ্বীপ থেকে ট্রাকে করে টেকনাফ শহরে এসে পৌঁছেছে রোহিঙ্গারা। গতকাল বিকেলে টেকনাফ বাসস্ট্যান্ড থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো

কক্সবাজার থেকে সাগরের সৈকত ঘেঁষে টেকনাফ পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে ‘মেরিন ড্রাইভ’। এই সড়কের পাশে ঝাউবনের ছায়ায় ছায়ায় ত্রিপল ও প্লাস্টিক শিট দিয়ে একটি-দুটি করে ঝুপড়িঘর তৈরি শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত কক্সবাজারের টেকনাফ শহর এবং তার পার্শ্ববর্তী উখিয়া এখন এক অর্থে রোহিঙ্গা শহরে পরিণত হয়েছে।

শত শত রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে পথের পাশে। পর্যটকদের গাড়ির গতি একটু মন্থর হলেই দল বেঁধে শিশু-নর-নারী ছুটে এসে ছেঁকে ধরছে সাহায্যের জন্য। রোহিঙ্গাদের চাপে এককথায় টেকনাফ শহর নিজেই এখন বিপন্ন।

প্রতিদিন ভোর থেকে হেঁটে অথবা ট্রাক, পিকআপ, জিপ (চান্দের গাড়ি), অটোরিকশা, ইজিবাইকে করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসতে থাকে শহরে। দক্ষিণে শাহপরীর দ্বীপ এখন রোহিঙ্গাদের বন্দরে পরিণত হয়েছে। আট শর মতো জেলে নৌকা এখন মাছ ধরার বদলে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আনার ব্যবসায় লেগেছে। গভীর রাত অবধি চলছে এই পারাপার।

একজন কর্মকর্তার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। টেকনাফের সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পুটিবুনিয়ায় নতুন খোলা হয়েছে এই ক্যাম্পটি। তিনি একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, ২২ দিন ধরে স্রোতের মতো আসছে রোহিঙ্গারা। আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন এখানে আশ্রিতের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

 টেকনাফ বাসস্ট্যান্ডের পাশেরই মসজিদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে একটু খোলা জায়গা আছে। এখান থেকেই রোহিঙ্গাদের ট্রাকে, পিকআপে তোলা হচ্ছে। সারা দিন এখানে হাজারো মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। এটিই শহরের প্রধান সড়ক। প্রাণকেন্দ্রের এই জনজটের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। কক্সবাজার থেকে আসা যানবাহনগুলোর টেকনাফ শহরে প্রবেশ করার জন্য দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এই সারি কখনো কখনো দেড়-দুই কিলোমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে যাচ্ছে। প্রায় একই অবস্থা শহর থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রেও। পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে এই জনস্রোত আর যানবাহনের স্রোত সামাল দিতে।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইন উদ্দিন খান বললেন, টেকনাফ ছোট্ট শহর। সড়কগুলোও সংকীর্ণ। হঠাৎ এত লোকসমাগম হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হয়ে উঠছে। 

টেকনাফে লোকসংখ্যা ২ লাখ ৮২ হাজার হলেও ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৪৮ হাজার ১০ জন। এখানে রোহিঙ্গাদের বড় আশ্রয়কেন্দ্র পুটিবুনিয়া (নতুন), লেদা (অনিবন্ধিত) ও নয়াপাড়া (সরকারি নিবন্ধিত) এই তিনটি। এই তিন কেন্দ্রে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা আড়াই লক্ষাধিক। ক্যাম্পগুলোতে লোকসংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এ ছাড়া পাহাড়ের ঢালে, সড়কের পাশে অনেক ছোট ছোট বস্তি গড়ে উঠেছে। আবার অনেকে তাদের পতিত ভিটায় বাঁশ, ত্রিপল, প্লাস্টিক দিয়ে লম্বা ঘর করে ভেতরে বেড়া দিয়ে আলাদা করে রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিচ্ছেন। এসব দশ বাই দশ হাত ঘরের মাসিক ভাড়া সাত শ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরেও এসব ঘরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা থাকছে। তুলনামূলক সচ্ছল রোহিঙ্গারা টেকনাফ শহরে বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে।

টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বললেন, শহরে এখন এমন কোনো বাড়ি পাবেন না, যেখানে রোহিঙ্গা নেই। অনেক রোহিঙ্গা কয়েক বছর ধরে বাড়ি ভাড়া করে আছে। নতুন আসা রোহিঙ্গারা এসব বাড়িতে আত্মীয়তা বা পরিচয় সূত্রে উঠছে। টেকনাফ শহরের এখন ভাড়াবাড়ির প্রধান গ্রাহক রোহিঙ্গারা। কোথাও বাড়ি ভাড়ার খবর পেলেই তারা সেখানে গিয়ে দরদাম করে উঠে পড়ছে। সব মিলিয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়েছে। স্থানীয় লোকজনই এখন সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত হচ্ছে।

কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, এসব বাড়িতে রোহিঙ্গারা থাকছে অনেকটা মেসবাড়ির মতো করে। মেঝেতেই ঢালা বিছানা করে থাকছে। জাফর আলম নামের একজন থাকেন শহরের মৌলভীপাড়ায় দুই ঘরের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে। তাঁরা এসেছেন মংডুর কাদির বিল এলাকা থেকে। এখানে তাঁর সঙ্গে আরও একটি পরিবার থাকে। লোকসংখ্যা মোট ১৭। পলিথিন ও বেড়ার এই বাসার একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছে মাসিক দেড় হাজার টাকায়।

শহরের নাজিরপাড়ায় দূরসম্পর্কের এক চাচার বাড়িতে উঠেছেন মো. রফিক। ৪ সেপ্টেম্বর এসেছেন তিনি চার সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে। এখন চেষ্টা করছেন আলাদা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার। কিন্তু খালি বাসা পাচ্ছেন না।

টেকনাফ শহরে এখন পথে বের হলেই পড়তে হয় সাহায্যপ্রার্থী রোহিঙ্গাদের সামনে। নতুন-পুরোনো রোহিঙ্গা মিশে গেছে। শহরের প্রধান সড়ক থেকে মহল্লার ভেতরের সড়ক, পাড়ার মোড়, বিপণিবিতান, নির্মাণাধীন ভবন, খাবার হোটেলের সামনে ভিড় করে থাকে তারা। নারীরা বোরকা পরে শিশু কোলে নিয়ে পথে পথে খাবার আর অর্থের সন্ধানে ঘুরছেন। অনেক শিশু-কিশোরও নেমেছে ভিক্ষায়।

স্থানীয় বাসিন্দারা বিরক্ত, অতিষ্ঠ। টেকনাফ উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও প্রবীণ শিক্ষক জাহেদ হোসেন তো বলেই ফেললেন, ‘সরকার মানবিকতা দেখাতে গিয়ে নিজের সন্তানদের কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে পরের সন্তানকে বুকে তুলে নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে আমাদেরই এখন জায়গা নেই। তাদের জন্য পাহাড়, রাবার বাগান, সংরক্ষিত বন কেটে হাজার হাজার একর জায়গায় ক্যাম্প করা হচ্ছে। তাদের অনুপ্রবেশ চলছে। এখানেও বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। মূল জনগণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। একদিন এমন হবে যে সত্যি আমরা আর টেকনাফে থাকতে পারব না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের এখনই নির্দিষ্ট স্থানে না রাখলে পরে বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে ঢুকছে। রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে আশ্রয় ও বাসা ভাড়া না দিয়ে তাদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্পে পাঠানোর জন্য প্রতিদিন এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও টেকনাফের রাস্তাঘাট ও খোলা জায়গায় প্রচুর রোহিঙ্গা দেখা যাচ্ছে। অনেকে বাসা ভাড়া করে আছে বলেও শুনেছি।’

উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের ঢল

উখিয়ার কুতুপালং থেকে বালুখালী পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার এলাকা এখন রোহিঙ্গাদের জনসমুদ্র। নতুন-পুরোনো আশ্রয়কেন্দ্র মিশে একাকার। এখানে বড় চারটি আশ্রয়কেন্দ্র। এগুলো হলো থাইংখালী (নতুন), কুতুপালংয়ের টেলিভিশন উপকেন্দ্র, কুতুপালং পাহাড় (সরকারি নিবন্ধিত) ও বালুখালী। এখন এসব আশ্রয়কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে উপজেলার পুনর্বাসন ও ত্রাণ নিয়ন্ত্রণ তথ্যকেন্দ্রের সূত্র জানিয়েছে। সড়ক থেকেই দেখা যায়, পাহাড়গুলোর গাছপালা কেটে মাথা থেকে গোড়া পর্যন্ত লবণ মাঠের ব্যবহৃত কালো প্লাস্টিক সিট দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করা হয়েছে। রাবার বাগান ভরে গেছে এসব ঝুপড়িতে। নির্মাণাধীন ভবন, ইটখোলা, সড়কের দুই পাশ, খালের পাড়জুড়ে কেবল রোহিঙ্গাতে বস্তি আর বস্তি।

উখিয়ার কুতুপালং সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রের দায়িত্বে রয়েছেন ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব রেজাউল করিম। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, এই বিপুল জনস্রোতের চাপ সামলানো খুবই দুরূহ হয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এলাকার স্বেচ্ছাসেবীরা রাত-দিন কাজ করছেন। এই নতুন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আরও অন্তত দুই হাজার একর জায়গার প্রয়োজন হবে। সরকারিভাবে এই জায়গা অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।