বিচ্ছেদীর বিষাদময় সুরে ঘুরছে জীবনের চাকা

একজনের হাতে হারমোনিয়াম, আরেকজনের হাতে করতাল, এর সঙ্গে তাল দিচ্ছে অন্য দুজনের নাল ও প্রেমজুড়ি। বাদ্য-বাজনার তালে তালে গানের আসর জমেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরোনো কাচারি পুকুরের পাড়ে, আবদুল কুদ্দুস মাখন পৌর মুক্তমঞ্চে। সামনে দর্শকদের ভিড়। তাঁরা মজেছেন রাধারমণ-আক্কাস দেওয়ান আর বিচ্ছেদী গানের সুরে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছয় সদস্যের এ গানের দলের সঙ্গে রয়েছেন একজন সহযোগী। তিনি মাইক্রোফোন এমুখ থেকে ওমুখে ধরে সুরের লয় ঠিক রাখছেন। মানুষের কাছ থেকে টাকাও তোলেন। এ টাকায় চলে দলটির সদস্যদের জীবন।

এ পরিবারের প্রধান হেলাল মিয়া। পরিবারটির নয়জনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। আর এর মধ্যে আটজনই জন্মান্ধ। জীবনধারণের জন্য তাঁদের একমাত্র অবলম্বন গান। বিচ্ছেদী গানের বিষাদময় সুরেই ঘোরে তাঁদের জীবনের চাকা। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের রাজঘর গ্রামে হেলাল মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের চারচালা একটি ঘরের দুটি কক্ষে তাঁদের বসবাস। নানান বিষয় নিয়ে হেলাল ও তাঁর ছেলেদের সঙ্গে কথা হয়। হেলাল চোখে না দেখেই মুঠোফোনে যে কোনো নম্বর ডায়াল করতে পারেন। একবার একটা নম্বর তাঁর মুঠোফোনে সংযুক্ত করলে তা কলের তালিকা নম্বর থেকে ফোন করতে পারেন।

দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা হার মেনেছে মনের আলোতে
অক্ষম-সক্ষম অনেক দরিদ্র মানুষ যেখানে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন চালায়, সেখানে দৃষ্টিহীন এ পরিবার গানকেই করেছে জীবিকার অবলম্বন। গান গেয়ে আয় করেন তাঁরা। দৃষ্টিহীন হেলাল মিয়ার জীবনের গল্পটি অনেক সংগ্রামের। নিরন্তর এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হেলাল মিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় পরিচিত নাম। জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর পরিচিতি দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও ছড়িয়েছে।

শারীরিক অক্ষমতা বেশির ভাগ মানুষের কাছেই বড় প্রতিবন্ধকতা। তবে হেলাল, তাঁর চার ছেলে ও এক মেয়ের কাছে শারীরিক অক্ষমতা মোটেও প্রতিবন্ধকতা নয়। তাঁর মনের আলোর শক্তির কাছে হার মেনেছে দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা।

দৃষ্টিহীনতাই যেন নিয়তি
হেলাল মিয়া জানালেন, তাঁর বয়স যখন সাত-আট বছর, তখনই পিঠে একটি টিউমার অপারেশনের কিছুদিন পর দুই চোখের দৃষ্টি চলে যায়। হেলালের বয়স এখন ৫৫ বছর। তাঁর চার ছেলে ও চার মেয়ে। এদের মধ্যে চার ছেলে, এক মেয়ে, দুই নাতি ও এক নাতনি জন্মান্ধ। স্বাধীনতা–পূর্ববর্তী সময়ে স্থানীয় এক ওস্তাদের কাছে গানের তালিম নেন। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গান গাইতে থাকেন। একসময় আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের রেজিয়া বেগমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। গান গেয়ে আয় হতে থাকে, তা দিয়ে টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে কোনো রকম চলছিল তাঁদের সংসার। একে একে তাঁদের সংসারে আসে আট সন্তান। এর মধ্যে চার ছেলে ও এক মেয়ে জন্মান্ধ।

অন্ধত্বের যেন এখানেই শেষ নয়। বড় ছেলে সাদেকের দুই শিশুসন্তান এবং দ্বিতীয় ছেলে ফারুকের এক শিশুসন্তানও জন্মান্ধ। হেলাল অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বলেন, একজন সুস্থ ছেলের আশায় একের পর এক সন্তান নিয়েছেন। কিন্তু দৃষ্টিহীনতাই যেন তাঁদের নিয়তি। পুরো পরিবারে এখন আটজন জন্মান্ধ।

দেশের নামকরা শিশু চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ আই হসপিটালের চিকিৎসক কাজী সাব্বির আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বংশগতির (জিনগত) কারণে অন্ধত্ব হয়ে থাকে। তবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত করে বলা যায় না।

বাড়ির আঙিনায় পুকুরপাড়ে গান গাইছেন হেলাল মিয়া ও তাঁর সন্তানেরা। ছবি: প্রথম আলো
বাড়ির আঙিনায় পুকুরপাড়ে গান গাইছেন হেলাল মিয়া ও তাঁর সন্তানেরা। ছবি: প্রথম আলো


সংগ্রাম গান নিয়েই
হেলালের পরিবার জানায়, দৃষ্টিহীন বড় মেয়ে খায়রুনের এখনো বিয়ে দিতে পারেননি। অন্য তিন মেয়ের মধ্যে একজনকে বরিশালে, আরেকজনকে কিশোরগঞ্জে এবং ছোট মেয়ে শারমিনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে বিয়ে দিয়েছেন। শারমিনই এখন গান গানের দলটির সঙ্গে এখানে–সেখানে নিয়ে যান। মাইক্রোফোন হাতে গায়ক দলের সামনে সহযোগির ভূমিকায় থাকেন। মোট কথা ব্যবস্থাপকের ভূমিকা পালন করেন শারমিন।

হেলাল বলেন, পরিবারের দৃষ্টিহীন সদস্যদের কারোর করুণার পাত্র না করতেই তাঁদের সবাইকে গানের তালিম দিয়েছেন। প্রতি শনি থেকে বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তমঞ্চে গান গেয়ে দিনে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পান। এর মধ্যে যাতায়াত বাবদ তিন–চার শ এবং খাওয়াদাওয়া বাবদ দুই শ টাকা চলে যায়। বাকি টাকা দিয়েই চলে সংসার। সম্প্রতি কয়েক মাস ধরে পরিবারের পাঁচজন সদস্য ৬০০ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন।

হেলাল মিয়া জানালেন, গত বছর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে তাঁদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার হয়। পাশাপাশি তাদের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। সে টাকা দিয়ে ছোট মেয়ে সাবিনার বিয়ের খরচ মিটিয়েছেন। বাকি টাকায় রাজঘর গ্রামে ছোট একটি টিনের ঘর নির্মাণ করছেন।

ভবিষ্যতের আলোর খোঁজে
খুবই অপর্যাপ্ত ও অনিয়মিত রোজগারে চলা একটা বড় পরিবারের প্রধান হিসেবে হেলাল মিয়া ভবিষ্যতের চিন্তা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাঁর কাছে গানের কোনো বিকল্প নেই। গান নিয়েই জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে চান। নিজের সন্তানদের শিক্ষার আলো না দিয়ে গানের তালিম দিয়েছিলেন, যা দিয়েই চলছে জীবনের চাকা।

তবে পরিবারের ছোট তিন সদস্যকে সুযোগ পেলে শিক্ষার আলো দিতে চান। তিন নাতি–নাতনিকে শিক্ষার পাশাপাশি গানেও তালিম দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। তাঁর স্বপ্ন, সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে ডাক আসবে তাঁর দলের কাছে। আর গান শুনিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করবেন সবাইকে। পাশাপাশি জুটবে বেঁচে থাকার আলো।