দেশসেরা স্বরলিকার গল্প

প্রথমে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন। এরপর জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয়। সেমিফাইনালে দল হেরে যায়। দল হারলেও হারেনি স্বরলিকা পারভিন। একের পর এক হ্যাটট্রিক করে গেছে। এ বছর বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে দেশসেরা হয়েছে ‘ছিটের মানুষ’ স্বরলিকা।

গ্রামের নাম বাঁশজানি। কাঁচা-পাকা সড়ক। বেশির ভাগই টিনের ঘর। আর দশটা গ্রামের মতোই চেহারা। ব্যতিক্রম হচ্ছে, এটি বিলুপ্ত এক ছিটমহল। গ্রামের তিন দিক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমার সীমানা। কিছুদিন আগেও বাঁশজানিবাসীকে ছিটের মানুষ বলে ডাকত সবাই। এখন এই গ্রাম বাংলাদেশের অংশ।

কখনোই বাঁশজানি নামটি তেমন আলোচনায় আসেনি। কিন্তু গ্রামের ১১ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে গ্রামটির নাম উজ্জ্বল করেছে। তারা এবারের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেয়। প্রথমে রংপুর বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আলোচনায় আসে। জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়নি ঠিকই, তবে দলের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় স্বরলিকা পারভিন সেই ঘাটতি অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের তিনটি ম্যাচের মধ্যে সে দুটিতেই হ্যাটট্রিক করে। এর আগে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে দুটি হ্যাটট্রিক করে। স্বরলিকা টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হয়ে পুরস্কার নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে।

স্বরলিকা বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পুরস্কার দিছেন। সঙ্গে ২৫ হাজার ট্যাকা। পুরস্কার দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেন, “তোমার বাড়ি বিলুপ্ত ছিটমহলে। ভালো করে খেলো।” এটি আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের। এ ছাড়া এতগুলো ট্যাকা একসঙ্গে কোনো দিন দেখি নাই।’

কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে বাঁশজানি গ্রামের দূরত্ব ৫১ কিলোমিটার। গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল মাঠ নিয়ে বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয়। মাঠে এক পাশে বিশাল বটগাছ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে।

সেরা খেলোয়াড়ের স্মারক হাতে স্বরলিকা পারভিন। ছবি: ছুটির দিনে
সেরা খেলোয়াড়ের স্মারক হাতে স্বরলিকা পারভিন। ছবি: ছুটির দিনে

স্বরলিকার বাড়ির অবস্থান জানতে চাইলে স্থানীয় কয়েকজন পথ দেখিয়ে দেন। বিদ্যালয় থেকে পশ্চিমে ইট বিছানো আঁকাবাঁকা সড়ক ধরে কিছু দূর এগোলেই স্বরলিকাদের বাড়ি। টিনের নতুন একটি ঘর। রোদ পড়ে চকচক করছে। নাম ধরে ডাকতেই এক শিশু দৌড়ে আসে; ভেতরে নিয়ে যায়। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিছানার ওপর একটি বল ও জার্সি পড়ে আছে। শোকেস ভর্তি পদক, ক্রেস্ট ও ট্রফি। কিছুক্ষণ পর স্বরলিকা এল। জানিয়ে দিল, এ পর্যন্ত মোট পুরস্কার পেয়েছে ২২টি। এর মধ্যে পদক ১০টি, ক্রেস্ট ১১টি ও ট্রফি ১টি।

স্বরলিকা পারভিন বাঁশজানি উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা সহিদুল ইসলাম পেশায় দিনমজুর। মা স্বপ্না বেগম গৃহিণী। স্বরলিকা বলল, ‘আমাদের পরিবার খুব গরিব। বাবা দিনমজুরি করে সংসার চালান। বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি নেই। তার ওপর ছিলাম ছিটের মানুষ। এত দূর আসতে পারব কখনো ভাবিনি। পরিবার এবং এখানকার সমাজ মেয়েদের ফুটবল খেলার পক্ষে ছিল না। সবকিছু সম্ভব হয়েছে স্কুলের আতিকুর রহমান ও বায়োজিত হোসেন স্যারের জন্য।’

স্বরলিকার ফুটবলে হাতেখড়ি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়। তখন বিদ্যালয়ের মাঠে বড় মেয়েরা ফুটবল খেলত। স্মরলিকা মাঠের বাইরে বসে খেলা দেখত। একদিন এক শিক্ষক তাকে ফুটবল খেলতে বলেন। রাজি হয়ে যায় স্বরলিকা। সেই থেকে শুরু। প্রতিদিন ক্লাস শেষে বিকেলে মাঠে খেলে সে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন, কীভাবে বল মারতে হবে, গ্রহণ করতে হবে।

ফুটবলই স্বরলিকা স্বপ্ন
ফুটবলই স্বরলিকা স্বপ্ন

স্বরলিকাদের স্কুল ২০১৫ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা ফুটবলে অংশ নিয়েছিল। স্বরলিকাও সে দলে ছিল। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ের খেলাতেই তাদের দল হেরে যায়। ২০১৬ সালে উপজেলা চ্যাম্পিয়ন হলেও জেলা পর্যায়ে হেরে যায়। ২০১৭ সালে জেলা পর্যায়ে জয়ী হয় এই দল। এরপর বিভাগীয় পর্যায়েও চ্যাম্পিয়ন। স্বরলিকা বলে, ‘জাতীয় পর্যায়ের প্রথম খেলা ২০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিপক্ষ ছিল রাজশাহী। আমরা ৩ গোলে জয়ী হই। তিনটি গোলই আমি করেছিলাম।’ তাদের দ্বিতীয় খেলা ছিল খুলনার সঙ্গে। সেটিতে তারা হেরে যায়। তৃতীয় খেলায় চট্টগ্রামের সঙ্গে ৪ গোলে জয়ী হয় স্বরলিকাদের স্কুল। স্বরলিকা ৩টি গোল করেছিল।

কথা বলার সময় স্মরলিকার মা স্বপ্না বেগম ও বাবা সহিদুল ইসলাম এসে দাঁড়ালেন। মেয়ের সাফল্য কেমন লাগে? উত্তরে সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। গ্রামে থাকি। মেয়ের খেলাধুলায় প্রথম দিকে বাধা দিতাম। এখন ভালোই লাগে।’

বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খালেদা পারভিন, শিক্ষক আতিকুর রহমান, বায়োজিত হোসেন, প্রশিক্ষক আবদুল মতিনসহ গ্রামের অনেকেই উচ্ছ্বসিত স্বরলিকাদের সাফল্যে। তাঁদের মতে, স্বরলিকা অনগ্রসর এই এলাকার জন্য বড় একটা কিছু করেছে।

কথার শেষে স্বরলিকা বলে, ‘আমরা গ্রামে বড় হচ্ছি। খেলাধুলার সুযোগ কমে আসছে। বিকেএসপি বা অন্য কোনো ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেলে আমরা আরও ভালো করব।’