পুরান ঢাকায় সাকরাইনের ঘুড্ডিবাজি

সাকরাইন উপলক্ষে মুখে কেরোসিন নিয়ে আকাশে আগুনের গোলা ছুড়ছেন তরুণেরা। গতকাল সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার বাংলাবাজার থেকে​ ছবিটি তুলেছেন সাইফুল ইসলাম
সাকরাইন উপলক্ষে মুখে কেরোসিন নিয়ে আকাশে আগুনের গোলা ছুড়ছেন তরুণেরা। গতকাল সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার বাংলাবাজার থেকে​ ছবিটি তুলেছেন সাইফুল ইসলাম

‘বাকাট্টা লট, লট...’ ‘ওই! ধর ধর!’ ছেলেবুড়ো সবাই ছুট লাগাল কাটা পড়া চোখদার ‘ঘুড্ডি’ ধরতে। ঘুড়ি এখানে ঘুড্ডি আর ‘ভোকাট্টা’ হলো বাকাট্টা। নিজস্ব বুলি আর ঢঙে পুরান ঢাকাবাসী পালন করল পৌষসংক্রান্তির ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব ‘সাকরাইন’।
বাংলা মাসের হিসাবে গতকাল শনিবার ছিল পয়লা মাঘ। কিন্তু পুরান ঢাকায় পৌষসংক্রান্তির ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন ছিল এদিনেই। ‘দিনপঞ্জির তারিখ আর উৎসবের দিনক্ষণ আলাদা কেন?’ দয়াগঞ্জের বাসিন্দা জাবির আহমেদ বললেন, ‘১৪ এপ্রিল যেমন পয়লা বৈশাখ, ১৪ জানুয়ারি সাকরাইন তেমনি ফিক্সড হয়া গেছে। বড় কোনো কারণ ছাড়া এই তারিখ বদল হয় না।’
তারিখ যা-ই হোক, সাকরাইন উপলক্ষে গতকাল লালবাগ থেকে কদমতলী পর্যন্ত পুরান ঢাকার আকাশজুড়ে ছিল রংবেরঙের ঘুড়ির ওড়াউড়ি। বিশেষ করে চকবাজার, ফরাশগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, নারিন্দা ও দক্ষিণ মুহসেন্দি এলাকায় উৎসবের জৌলুসটা একটু বেশি। প্রায় প্রতিটি ছাদেই ঘুড়িবাজদের জটলা। আকাশ ছেয়ে থাকা ঘুড়িগুলো যেন রঙিন বিন্দু।
সকাল থেকেই পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়ে যায় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে থাকে ছাদে ছাদে। তবে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন যতজনে তাঁদের চেয়ে ঢের বেশি ছিলেন উৎসাহদাতা। অবশ্য সামনের ছাদের প্রতিপক্ষকে ‘ভুয়া, ভুয়া’ দুয়ো দেওয়া কিংবা কাটাকাটি খেলায় নিজেদের জয়ে ‘বাকাট্টা লট’ চিৎকারের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হচ্ছিল তাঁদেরই।
কোনো ছাদে এলাকার ভাই-বন্ধুরা মিলে উৎসবের আয়োজন করেছেন। আবার কোথাও পারিবারিক উদ্যোগে আয়োজন। কিন্তু নিমন্ত্রণ সবার। গেন্ডারিয়ার সাদাফ আমির বলেলন, এদিন সবার জন্য দ্বার খোলা থাকে। এলাকার যার ছাদেই আয়োজন থাক, সবাই সেখানে যেতে পারে।
ঘুড়িবাজির সঙ্গে মেহমানদারিও সাকরাইনের একটি অংশ। ফরিদাবাদে শাহরিয়ার ওমরদের বাড়িতে জমায়েত হয়েছিলেন আত্মীয়-বন্ধুসহ অনেকে। শাহরিয়ার বললেন, প্রতিবছরই এমন আনন্দের ব্যবস্থা থাকে।
পুরান ঢাকার এই উৎসব নিয়ে এখন সারা ঢাকাবাসীরই বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইভেন্ট খুলে জানানো হচ্ছে সাকরাইনের দিনক্ষণ। প্রথমবারের মতো সাকরাইন দেখতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইফফাত জাহান। বললেন, ‘নিজেদের এত সুন্দর উৎসব রেখে আমরা কেন ভিনদেশি উৎসব ধার করছি? শুধু পুরান ঢাকা না, সারা দেশেই সাকরাইন পালন হওয়া উচিত।’ শান্তিনগরের বাসিন্দা আলভী আহমেদও বললেন, ‘পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সরকার এই উৎসবকে কাজে লাগাতে পারে।’
গোধূলি পর্যন্ত চলে মাছল্যাঞ্জা, গায়েলদার, শিংদার, পানদারের লড়াই। তারপর শুরু হয় উৎসবের দ্বিতীয় পর্ব—কেরোসিন মুখে নিয়ে আগুনে ফুঁক আর আতশবাজি। কয়েক বছর ধরে সাকরাইনে যোগ হয়েছে ফানুস ওড়ানো। কেউ কেউ রাতভর ডিজে পার্টিরও আয়োজন করেন। তবে এই নতুন নতুন সংযোজনে হারিয়ে গেছে কিছু পুরোনো রীতি। আগে সাকরাইনের এক-দুই দিন আগে থেকেই শুরু হতো সুতা মাঞ্জা দেওয়ার পর্ব। সাদা সুতার গোছা কিনে রং আর কাচের গুঁড়ার প্রলেপ দিয়ে সুতা ধারালো করা হতো। এখন আর মাঞ্জা দেওয়া হয় না।