তিনি এখন নিজেই অন্যদের 'চোখের আলো'

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তির সাহায্যে আলোর পথ দেখান ভাস্কর ভট্টাচার্য। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তির সাহায্যে আলোর পথ দেখান ভাস্কর ভট্টাচার্য। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

চোখের সামনে শুধু ছায়া দেখতে পান। ছোটবেলায় সঙ্গীরা তাঁকে খেলায় নিতেন বটে, তবে তাঁর তেমন কোনো ভূমিকা থাকত না। এতে তিনি যে চোখে দেখেন না, অন্যদের চেয়ে আলাদা, তা বুঝতেই পারতেন না। বাসায় মেহমান এলে মা নীরবে কান্না করতেন। তখন মায়ের মুখে হাত দিলে ভেজা ভেজা লাগত। ভেজা হাত মুখে গেলে নোনতা লাগত।

ভাস্কর ভট্টাচার্য এভাবেই বলছিলেন তাঁর শৈশবের অনুভূতির কথা। এখন আর ভাস্কর ভট্টাচার্যকে নিয়ে কান্নাকাটি করার কিছু নেই। এখন সবাই তাঁকে নিয়ে গর্ব করেন। আর তাঁকে ‘নিষ্ক্রিয়’ হিসেবে রাখতে হয় না, তিনিই এখন অন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রযুক্তির সাহায্যে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। ভাস্কর বলেন, ‘ছোটবেলায় মেহমানের কাছে মা আমার কথা বলে কেন যে কান্না করতেন, তা বুঝতাম না। ভাবতাম, মায়েদের মুখ ভেজা হয় আর তার স্বাদ নোনতা লাগে।’

স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন সংগঠন ‘ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন ইপসা’র জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম ম্যানেজার এবং সরকারের এটুআই প্রোগ্রামের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট-একসেসিবিলিটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ভাস্কর ভট্টাচার্য। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার জন্য ভাস্কর এ পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন।

গত বছরের ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেসকো সদর দপ্তরে ‘ডিজিটাল এমপাওয়ারমেন্ট অব পারসন্স উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি’ অনুষ্ঠানে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। কুয়েতের সহায়তায় প্রবর্তিত ও সে দেশের সাবেক আমির জাবের আল আহম্মদ আল জাবের আল সাবাহর নামে এ পুরস্কারের নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে ভাস্কর এই পুরস্কার পান।

সম্প্রতি প্রথম আলোর কার্যালয়ে বসে আলাপের একপর্যায়ে ভাস্কর জানালেন, ইউনেসকোর পুরস্কারের জন্য তিনি যে অর্থ পাবেন, তা ব্যক্তিগত খাতে ব্যয় করবেন না। এ অর্থ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নেই কাজে লাগাতে চান।

ছোটবেলায় নতুন বই হাতে পাওয়ার যে আনন্দময় অনুভূতি, তা অনুভব করতে পারেননি ভাস্কর। পুরোনো বই মা-বাবা পড়ে শোনাতেন, তিনি শুনতেন। কখনো কখনো স্কুলের আবদুস সামাদ স্যার কষ্ট করে ম্যানুয়ালি ব্রেইল করে দিতেন। তবে ভাস্করের উদ্ভাবনে বর্তমানে প্রথম থেকে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল টকিং বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। ডেইজি মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল বই পড়তে, শুনতে ও দেখতে পাওয়া যায়। বইগুলোর ডিজিটাল ব্রেইল কপিও আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে এ সুযোগ পান, তার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা একসেসিবল ডিকশনারি ব্যবহার করছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ওয়েবসাইট যাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ব্যবহার করতে পারেন, তার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের আওতায় এটুআইয়ের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন ভাস্কর।

কাজ করছেন ভাস্কর ভট্টাচার্য। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
কাজ করছেন ভাস্কর ভট্টাচার্য। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ভাস্কর বলেন,‘মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বই পড়ে দেওয়ার জন্য বায়না করত। তাকে বোঝাতে পারতাম না আমি পড়তে পারি না। তারপরই মাথায় আসে একসেসিবল বই করার বিষয়টি।’ বর্তমানে শুধু পাঠ্যপুস্তক নয়, প্রজনন স্বাস্থ্য, এইচআইভি–এইডস থেকে সুরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়েও শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই তথ্য পাচ্ছেন।

ভাস্কর জানালেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামনে কোনো গর্ত থাকলে, বাধা থাকলে তা যাতে সাদাছড়ি বাংলায় বলে দিতে পারে, সে ধরনের উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করছেন।

২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন সফল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে সম্মাননা তুলে দেন ভাস্করের হাতে। জিরো প্রজেক্ট অ্যাওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল একসেসিবল পাবলিশিং ইনিশিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড, আইএসআইএফ এশিয়া অ্যাওয়ার্ড, মাইক্রোসফট ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড, হেনরি ভাস্কারদি অ্যাওয়ার্ডসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন ভাস্কর। তাঁর উদ্ভাবিত মাল্টিমিডিয়া টকিং বুকের জন্য ডব্লিউএসআইএস পুরস্কার পায় সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম।

ভাস্কর ভট্টাচার্য পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে তিনি এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের তরুণদের জন্য জাপান সরকারের ডাস্কিন লিডারশিপ ট্রেনিংয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।

ইউনেসকোর পুরস্কারের অর্থ ব্যক্তিগত খাতে ব্যয় করবেন না ভাস্কর ভট্টাচার্য। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
ইউনেসকোর পুরস্কারের অর্থ ব্যক্তিগত খাতে ব্যয় করবেন না ভাস্কর ভট্টাচার্য। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কাঠখড় পোড়াতে হয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ভাস্করের হাত ধরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ই-লার্নিং ল্যাবে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পড়াশোনা করতে পারছেন।

ব্যক্তিজীবনে ভাস্কর দুই মেয়ের জনক। তাঁর স্ত্রী শ্যামশ্রী দাশ ইপসাতে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হয়েছে।

ভাস্কর জানালেন, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবেশগম্য একটি অনলাইন তৈরির কাজ করছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বুক শেয়ার একসেসিবল অনলাইন লাইব্রেরির একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিল। দীর্ঘদিন থেকে আলাপ–আলোচনার পর প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এ লাইব্রেরি বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারবেন বলে সম্মত হয়েছে। এতে করে ৪ লাখ ৪০ হাজার বই পড়ার সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা।

ভাস্কর আবার চলে গেলেন ছোটবেলায়। জানালেন, গ্রামে জন্মের পর সুচিকিৎসার অভাবে নানান জটিলতা দেখা দেয়। দুই বছর বয়সে বাবা-মা বুঝতে পারেন, তিনি চোখে দেখেন না। তখন চিকিৎসক সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছিলেন, এ ছেলেকে দিয়ে কিছু হবে না। ছেলে কোনো দিন দেখতে পাবে না, তাই ছেলের পেছনে টাকা খরচ না করে জমিয়ে রাখলে ভালো হবে।

ভাস্কর বলেন, ‘বাবা-মা আমার দিকে বেশি নজর দেওয়ার কারণে আমার আরেক ভাই বঞ্চিত হয়েছে। বাবা-মায়ের পরেই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার স্ত্রী। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’

নিজেকে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে ভাস্কর জাপান, থাইল্যান্ড, ভারত, ফিলিপাইন, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো, তুরস্কসহ পৃথিবীর ৩০টিরও বেশি দেশে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতা নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান ও গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্তরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নিয়ে বিশেষ বক্তা হিসেবে প্রবন্ধ উপস্থাপন ও গবেষণা কাজে অংশগ্রহণ করে আসছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও জার্নালে নিয়মিত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখছেন।