কর্ণফুলী নদীতে সাম্পান বাইচ

ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটা ছুঁইছুঁই। কর্ণফুলী নদীর উত্তর তীরে চট্টগ্রাম নগরের অভয়মিত্র ঘাট ঘেঁষে আটটি সাম্পান একই রেখায় অবস্থান করছে। প্রতিটি সাম্পানে নয়জন করে মাঝিমাল্লা। সবার অপেক্ষা হুইসেলের। পাঁচটা বাজতেই হুইসেল বেজে ওঠে। শুরু হয় সাম্পান বাইচ। ঘামঝরানো দাঁড় বেয়ে চলেছেন মাঝিমাল্লারা। লক্ষ্য আগেভাগে নদীর দক্ষিণ পারে কর্ণফুলী থানার চরপাথরঘাটা ছোঁয়া।  

গতকাল শনিবার বিকেলে কর্ণফুলী নদীতে সাম্পান বাইচ দেখতে বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভিড় করে। বৈঠা নৌকা, ইঞ্জিনচালিত সাম্পান, নৌকা কিংবা স্পিডবোট নিয়ে নদীতে ঘুরে বেড়িয়েছে তারা। সবাইকে ছাড়িয়ে সাম্পান বাইচে প্রথম হয় জাহাঙ্গীর মাঝির দল। গতবারও এই দলটি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

‘কর্ণফুলী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ স্লোগান সামনে রেখে সাম্পান খেলা ও চাঁটগাইয়া সংস্কৃতি মেলা শিরোনামে একাদশ বারের মতো এই আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক একাডেমি। এতে সহযোগিতা করে সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন। মেলার শেষ দিনে গতকাল অনুষ্ঠিত হয় সাম্পান বাইচ।

প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয় যথাক্রমে ইসমত উল্লাহ শাহ মাঝির সাম্পান ও ফজল মাঝির সাম্পান। প্রথম দলকে ৪০ হাজার, দ্বিতীয় দলকে ২০ হাজার ও তৃতীয় দলকে ১০ হাজার টাকা মূল্যমানের ফ্রিজ পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়।

বাইচ দেখতে গতকাল দুই শতাধিক ছোট–বড় নৌকা ও সাম্পান নিয়ে নদীতে ভিড় করে দুই পারের লোকজন। এ ছাড়া দুই পারেও ছিল হাজার হাজার মানুষ। তারা সাম্পান বাইচ দেখতে অধীর আগ্রহে বেলা তিনটা থেকে অপেক্ষা করতে থাকে।

নদীর দক্ষিণ পারের বাসিন্দা মোবারক হোসেন একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে পরিবার নিয়ে বাইচ দেখতে আসেন। তিনি বলেন, মাঝিমাল্লারাও সবাই পরিচিত, তাই সাম্পান বাইচ দেখতে এসেছেন।

কোনো কোনো দর্শনার্থীর নৌকায় বাঁধা ছিল মাইক। সেখান থেকে ভেসে আসছিল কর্ণফুলী ও সাম্পান মাঝি নিয়ে লেখা জনপ্রিয় বিভিন্ন আঞ্চলিক গান। ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা’ কিংবা ‘কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে’ এসব গানের তালে তালে নেচে–গেয়ে আনন্দ করেন তরুণ-তরুণীরা। এ ছাড়া বেজেছে ঢোলসহ নানা বাদ্যযন্ত্র।

সাম্পান বাইচ উপলক্ষে কর্ণফুলী নদীতে ভাসমান লঞ্চের ছাদে শামিয়ানা টানিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়। বাইচের উদ্বোধন করেন কর্ণফুলী থানার চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী। বাইচ শেষে কর্ণফুলী থানার চরপাথরঘাটা সিডিএ মাঠে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। ইউপি চেয়ারম্যান ছাবের আহমদের সভাপতিত্বে এতে অতিথি ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল আলম, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ ও চট্টগ্রাম আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক একাডেমির চেয়ারম্যান আলীউর রহমান।

অতিথিরা বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে কর্ণফুলীকে সচল রাখতে হবে। আমরা সাম্পান খেলা ও চাঁটগাইয়া সংস্কৃতি মেলার মাধ্যমে কর্ণফুলী বাঁচানোর দাবি জানিয়ে আসছি।’

মেলা উপলক্ষে চরপাথরঘাটার সিডিএ মাঠে গ্রামীণ মেলা বসে। সেখানে গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী, খেলনা ও অন্যান্য সামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে। নাগরদোলায় চড়ছে শিশু–কিশোরের দল। গতকাল রাতে মেলার মঞ্চে লোকসংগীত ও লোকনৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।