ছাত্রের বক্তৃতায় আমার কথা, নোবেল পুরস্কারের মতো

২০০১ সালে ঢাকায় ভুটানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে লোটে শেরিংয়ের সঙ্গে এম খাদেমুল ইসলাম ও তাঁর পরিবার। ছবি: সংগৃহীত
২০০১ সালে ঢাকায় ভুটানের জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে লোটে শেরিংয়ের সঙ্গে এম খাদেমুল ইসলাম ও তাঁর পরিবার। ছবি: সংগৃহীত
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক এম খাদেমুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ঢাকার ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের চিফ কনসালট্যান্ট। খাদেমুল ইসলাম ছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংয়ের শিক্ষক। তবে লোটে শেরিং তাঁর বক্তৃতায় বলেন, এই শিক্ষকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘ছাত্র-শিক্ষকের’ চেয়েও বেশি কিছু। কীভাবে সম্পর্কটা এত গভীর হলো? বলেছেন ডা. এম খাদেমুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ।

স্যার আপনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। সারা দেশে আপনার অসংখ্য ছাত্র। এত ছাত্রের মধ্যে একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাও ভিনদেশে। কেমন লাগে?

অধ্যাপক ডা. এম খাদেমুল ইসলাম, ছবি: কবির হোসেন
অধ্যাপক ডা. এম খাদেমুল ইসলাম, ছবি: কবির হোসেন

এটা সত্যিই ভীষণ গর্বের ব্যাপার। অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যেও কেউ কেউ থাকে একটু ব্যতিক্রম, ডা. লোটে শেরিং সেরকম একজন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমি যখন অধ্যাপক, তখন শিক্ষার্থী হিসেবে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। মেডিকেল শিক্ষাজীবনের শেষে ইন্টার্নশিপের সময় ৬ মাস একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কাজ করতে হয়। এখন আমি বুঝতে পারি, কেন সে সার্জারি বেছে নিয়েছিল। শুরুতে তার নাকি শিশুবিশেষজ্ঞ হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সে সার্জন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার অধীনে ৬ মাস ইন্টার্নশিপ যখন শেষ হলো, ওই সময়েই আমি ট্রান্সফার হয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে চলে এলাম। ওর প্রশিক্ষণ শেষ হলো সম্ভবত ১৯৯৯ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে। একদিন সে এখানে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, ‘স্যার, আমি সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়তে চাই এবং বাংলাদেশ থেকেই আমার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নিতে চাই। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমি রাষ্ট্রীয় বৃত্তির আওতায় পড়তাম। এখন বৃত্তির সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। আমাকে দেশে ফিরে মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করতে হবে। কিন্তু আপনি যদি একটু সাহায্য করেন, তাহলে আমি এখানে থাকার সুযোগ পেতে পারি।’ আমি বললাম, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ মাই ডিয়ার সান?’ সে বলল, ‘আপনি যদি একটা রিকমেন্ডেশন লেটার দেন, তাহলে সম্ভবত সরকার আমাকে অনুমতি দেবে।’ আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার অফিশিয়াল প্যাডে তাকে একটা লেটার অব রিকমেন্ডেশন লিখে দিলাম। ৭ দিন পর সে হাসিমুখে আমার কাছে এল। বলল, ‘স্যার, আমাদের সরকার আমাকে বাংলাদেশে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার অনুমতি দিয়েছে।’

এরপর থেকেই তিনি আপনার তত্ত্বাবধানে ছিলেন?
হ্যাঁ। আমি ওকে আমার দলে অনারারি মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়ে নিলাম। সে সময় আমার সঙ্গে যত প্রশিক্ষণার্থী, মেডিকেল অফিসার কাজ করত, আমি সবাইকে ডাকলাম। বললাম, ও আমাদের সঙ্গে কাজ করবে, তোমরা ওকে সাহায্য কোরো। সবাই অন্তরঙ্গভাবে লোটেকে গ্রহণ করল। আমার মনে হয় ডা.লোটেকে যে কেউ খুব সহজে আপন করে নেবে, এই ধরনের কিছু মানবিক গুণাবলি তার মধ্যে আছে। কাজের ব্যাপারে সে খুব সিরিয়াস ছিল। আমি যদি বলতাম অতটার সময় একটা অপারেশন আছে, তুমি থেকো। সে অন্তত আধঘণ্টা আগে হাজির হয়ে যেত। গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোগীর সবকিছু দেখত। আমি কীভাবে ক্লিনিক্যাল ইভেলুয়েশন করেছি, কী ডায়াগনোসিস, আমার প্ল্যান অব ট্রিটমেন্ট কী, সব মাথার মধ্যে নিয়েই সে অপারেশন টেবিলে আমার সামনে আসত। তার একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকত যে কীভাবে আমি স্যারকে সাহায্য করতে পারি। আমি আমার সব কাজেই ওকে যুক্ত করেছিলাম। বক্তৃতায় ও যা বলেছে, সেটা সত্যি। আমি ওকে আমার ছেলেমেয়ের মতোই দেখি।

লোটে শেরিং দেশে ফিরে যাওয়ার পর কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল?
নিশ্চয়ই। ২০০২ সালের দিকে ও দেশে ফিরে যখন সরাসরি সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করল, ওর দক্ষতা দেখে অনেকে আশ্চর্য হয়েছিল—বাংলাদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে একজন তরুণ সার্জন কীভাবে এত বড় বড় অপারেশন এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করছে! কে তার শিক্ষক, প্রশিক্ষক? ভুটান এবং চিকিৎসকদের কমিউনিটিতে অনেকেই আমাকে চিনেছে লোটের মাধ্যমে। ওখানে যাওয়ার পর অন্তত প্রথম কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার ও আমাকে ফোন করেছে। হয়তো ওখানে কোনো অপারেশন করছে, এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন ওর কোনো পরামর্শ দরকার। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করত। আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য করতাম। অপারেশন শেষ করেই সে আবার ফোন করত। বলত স্যার, আপনার পরামর্শ খুব কাজে লেগেছে। পরে সে যখন আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে, তখন হয়তো পরামর্শ নেওয়ার জন্য আর ফোন করেনি। কিন্তু যোগাযোগ ছিল। যার ফলে ও যখন এবার বাংলাদেশে এল, আমরা প্রথম দিনেই বিসিপিএসে (বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস) তাকে একটা সংবর্ধনা দিয়েছি। আমার বন্ধুরা সবাই জানে ও আমার ছাত্র। তাই বিসিপিএস কর্তৃপক্ষ আমাকে ধরেছিল, আমি যেন সংবর্ধনার ব্যবস্থা করে দিই। বাংলাদেশে আসার আগে আমি ওকে ফোন করে বলেছি। ও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছে।

মাঝে কি আপনার কখনো ভুটানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল?

এখনো যাওয়ার সুযোগ পাইনি। ২০০০ সালে সে যখন আমার ছাত্র, তখন একবার পরিকল্পনা করেছিলাম ভুটানে যাব। আমাকে রিসিভ করার জন্য সে আগেই চলে গিয়েছিল। আমার পরিকল্পনা ছিল ভারতের মুম্বাইতে একটা কনফারেন্সে অংশ নিয়ে তারপর কলকাতা যাব। সেখান থেকে ভুটান যাওয়ার কথা। কিন্তু আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর যাওয়া হয়নি। লোটে একদম বর্ডার পর্যন্ত এসে খুব অনুরোধ করেছিল, ‘স্যার, আপনি কোনোভাবে ম্যাডামকে এখানে নিয়ে আসেন। বাকিটা আমি দেখব।’ আমি বললাম, ‘সরি মাই বয়, সে খুব অসুস্থ।’ এরপর আর যাওয়া হয়নি। তবে এবারও এসে ও আমাকে খুব করে বলে গেছে। ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে রাজকীয় অতিথি হিসেবেই যাব।

তাঁর বক্তৃতায় তিনি যে ঘটনাগুলো বলেছেন, সেগুলো কি আলাদাভাবে আপনার মনে আছে? তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন, কিংবা এফসিপিএস পরীক্ষার সময়ের কথা...

পরীক্ষার ব্যাপারটা আমার পরিষ্কার মনে আছে। কিন্তু অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের ব্যাপারটা সত্যি বলতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ও বলার পর মনে পড়ল। ওর পরীক্ষার আরেকটা ঘটনা আমার মনে আছে, যেটা আমি অনেক একাডেমিক সেশনে বলি। এফসিপিএস পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর সন্ধ্যায় ও আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। এসে বলল, ‘স্যার, আপনি অনুমতি দিলে আমি আমার পরীক্ষার সময়ের অভিজ্ঞতাটা বলব।’ বললাম, হ্যাঁ, বলো। তখন সে বলল, ‘স্যার, পরীক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি কখনোই বইয়ের পাতায় কী লেখা আছে সেটা স্মরণ করার চেষ্টা করিনি।’ সাধারণত শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করলেই তাদের মস্তিষ্ক চলে যায় বইয়ের পাতায়—কত নম্বর অধ্যায়ে কোথায় এই প্রশ্নের উত্তর আছে...ছাত্রছাত্রীরা খুঁজতে থাকে। কিন্তু লোটে বলল, ‘স্যার, আমি আপনার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়েছি। আপনি আপনার দৈনন্দিন ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসে কী করেন, সেটা আমি মনে করতে চেষ্টা করেছি। আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি উত্তর দিয়েছি এবং দেখেছি পরীক্ষকেরা আমার উত্তর শুনে খুশি হয়েছেন।’

লোটে শেরিংয়ের সঙ্গে কোনো বিশেষ স্মৃতি আপনার মনে পড়ে?

আরেকটা ঘটনা মনে আছে। ২০০৫ সালের মার্চ মাসে আমি হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে গেলাম। অপারেশন করতে করতেই আমার ঘাড়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জানতে পারলাম আমার ‘ডিস্ক কলাপস’ করেছে। তখন যে আমার অপারেশন করেছিল, সে-ও আমার ছাত্র। তো লোটে যখন খবরটা পেল যে আমার অপারেশন হয়েছে, সে তখন ভুটানের একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করছিল। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সে ঢাকার পথে রওনা হয়ে গেল। প্রায় দেড় দিনের ভ্রমণ শেষে সে যখন আমার সামনে দাঁড়াল, আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘লোটে তুমি এখানে!’ সে বলল, ‘স্যার, খবরটা শুনে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। স্যার আপনি এখন কেমন আছেন?’ অপারেশনের পর আমি কথা বলতে পারছিলাম না। লিখে লিখে কথা বলতে হচ্ছিল। এটা আমার জন্য একটা অনেক বড় পাওয়া। একজন শিক্ষকের প্রতি কতটা শ্রদ্ধা, কতটা ভালোবাসা থাকলে এত দূর থেকে একজন ছাত্র তার শিক্ষককে দেখতে আসতে পারে! অনেক সময় নিকটাত্মীয়রাও তো কাছে থেকেও আসে না। এ থেকেই বোঝা যায় যে ছাত্র-শিক্ষকের বাইরেও আমাদের একটা সম্পর্ক আছে।

বোধ হয় এটাও বোঝা যায়...যেটা আপনি শুরুতে বলছিলেন—আপনার এই ছাত্রটা অন্য রকম।

অবশ্যই। ওর বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের ও যেই বার্তাটা দিয়েছে—ভালো ছাত্র হতে হলে একজন ভালো মানুষ হতে হয়, নিশ্চিতভাবেই ভালো মানুষের গুণাবলি ওর মধ্যে আছে। আমি সব সময় দোয়া করি, ও জীবনে আরও বড় হোক। নিজের অবস্থান থেকে মানবতার জন্য আরও কাজ করুক। একজন শিক্ষক জীবদ্দশায় শিক্ষার্থীর এত বড় অর্জন দেখে যেতে পারেন, এর চেয়ে বড় পাওয়া তো আর কিছু হতে পারে না। এত মানুষের সামনে আমার ছাত্র বক্তৃতা দিতে গিয়ে আমার কথা বলেছে, এটা তো একটা নোবেল পুরস্কারের মতো। এই পুরস্কার আপনি বাজারে কিনতে পাবেন না। এটা আসে মানুষের অন্তর থেকে। সব সময় বলি, আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। লোটের বক্তৃতা ইউটিউবে ছড়িয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক ছাত্রছাত্রী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। বলেছে, ‘স্যার, আমরাও আপনার ছাত্র হতে পেরে গর্বিত।’ এটা একটা বড় পাওয়া। আরেকটা বড় পাওয়া হলো রোগীদের দোয়া। গ্রামগঞ্জের মানুষ যখন বলে, ‘স্যার, যখনই নামাজ পড়ি আপনার জন্য দোয়া করি। আপনি আমার অপারেশন করেছিলেন। আপনি সুস্থ থাকেন, ভালো থাকেন।’ মন ভরে যায়। আমি হৃদয় থেকে বিশ্বাস করি, মানুষের দোয়া খুব কাজে লাগে।