বিচারপতি ও আইনজীবীকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত: আইনমন্ত্রী

>২০১৭ সালের ৫ অক্টোবরে হাইকোর্ট (বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত) এক আদেশে রিটকারী এমআর ট্রেডিংয়ের অনুকূলে ১৩৬ কোটি টাকার ডিক্রি এবং ঋণের টাকা সমন্বয়ের পরে সম্পত্তি বিক্রির বাদবাকি ৪৮ কোটি টাকা এবং বন্ধকি আড়াই লাখ বর্গফুট আয়তনের বহুতল ভবন ফেরতদানে ন্যাশনাল ব্যাংকের ওপর ডিক্রি জারি করতে ঢাকার অর্থঋণ আদালতকে নির্দেশ দেন। বাদীর আইনজীবী ছিলেন শফিক আহমেদ। অর্থঋণ আদালত অনুরূপ আদেশ দানের পরপরই ১৬ নভেম্বর ২০১৭ হাইকোর্ট থেকে মূল মামলা তুলে নেওয়া হয়। ব্যাংক অর্থঋণ আদালতের আদেশ তামিল না করলে হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে (বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস সমন্বয়ে গঠিত) রিটকারী আদালত অবমাননার মামলা করেন। গত ২৮ এপ্রিল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মুস্তাক আহমেদের ওপর ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবরের হাইকোর্ট আদেশ অমান্যের দায়ে আদালত অবমাননা মামলার রুল জারি হয়। হাইকোর্ট তাঁকে ১৩ মে, ২০১৯ ব্যক্তিগতভাবে আদালতে হাজির হতে বলেছিলেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে ব্যাংক আপিল বিভাগে আসেন। এই মামলাসহ আইন অঙ্গনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে কথা বলেছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ ১৬ মে হাইকোর্টের একটি আদেশে সংক্ষুব্ধ হন। বেআইনি বিবেচনায় তা বাতিল করেন। এই বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

আনিসুল হক: ঘটনাটি দুঃখজনক। এটা সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। এতেই প্রতীয়মান হয়, আমরা জবাবদিহি বা দায়বদ্ধতার যে কথা বলি, সেটা অবশ্যই থাকা উচিত। আপিল বিভাগের বিজ্ঞ বিচারপতিদের এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমি সংশ্লিষ্ট মামলাটির সম্পূর্ণ ঘটনাটি জেনেছি। তাই একই সঙ্গে আমি বলব, এ বিষয়ে বাদীপক্ষের সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর বিষয়েও একটা ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

প্রথম আলো: আপনি কি একটু বলবেন, আলোচ্য মামলার বিষয়ে আপনার ধারণা কী রকম?

আনিসুল হক: সেটা নিশ্চয় আপনারাও শুনেছেন। আমি যা শুনেছি, সেটা পুনরাবৃত্তি করার দরকার নেই। আমরা যারা আইনজীবী, তাদের কিন্তু একটা দায়বদ্ধতা বেঞ্চের কাছে আছে। মক্কেলের পক্ষে আমরা যখন আদালতে যাই, তখন (আমার মরহুম বাবা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের কাছে শিখেছি যে), কখনোই কোর্টকে মিসলিড (বিভ্রান্ত) করা উচিত নয়। কোর্টের কাছে ফ্যাক্ট সাপ্রেস (তথ্য গোপন) করা উচিত নয়। বরং আইনের ব্যাপারে কোর্টকে সহায়তা করা উচিত। কারণ, আমরা ফ্রেন্ড অব দ্য কোর্ট (আদালতের বন্ধু)। আমরা কোর্টের অফিসার হিসেবে কাজ করি। বিচারপতিগণ যখন আমাদের কথা শোনেন, তখন তাঁরা আমাদের বিশ্বাস করেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের একটা দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা আছে। আমি মনে করি, আইনজীবীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ, প্রশ্নটা হলো আইনজীবী কেন মিসলিড করলেন, কেন তিনি আদালতকে ভুল তথ্য দিলেন। আর মাননীয় বিচারপতি যা করেছেন, সেটা আইনসিদ্ধ নয়। তার এই কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত এবং আমি বিশ্বাস করি, এ ব্যাপারটি আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিরা দেখবেন।

প্রথম আলো: কিন্তু হাইকোর্টের ওই বেঞ্চটি দুজনের (বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক) সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং দায়দায়িত্ব যৌথ বলে গণ্য হওয়া উচিত।

আনিসুল হক: আমি এখানে কমেন্ট (মন্তব্য) করতে চাই না। কিন্তু কিছু কনভেনশন আছে, সেটার বাইরে আমরা কেউ না। সেটা হলো যখন মোশনে অর্থাৎ একটি নতুন মামলা আদালতের সামনে আনা হয়, তখন বেঞ্চের যিনি জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, তাঁর কথাটাই বেশি থাকে। যখন নতুন মামলা অ্যাডমিশন (গ্রহণ) হয়, তখন দায়দায়িত্বটা বেশি হচ্ছে সিনিয়র জজের। তবে হ্যাঁ, আমি বলছি না যে জুনিয়র জাজের কোনো দায়িত্ব নেই।

প্রথম আলো: কিন্তু প্রশ্নটা হলো, ২০১৭ সালে ওই রিটে যে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে, সেটা একজন আইনজীবী পারেন কি না?

আনিসুল হক: (মৃদু হাসি) যে প্রতিকার বেআইনি বলেই আমি জানি, সেই প্রতিকার কেন প্রার্থনা করা হবে?

প্রথম আলো: মামলাটি অর্থঋণ আদালতের। সেই আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে রিট কি চলে না?

আনিসুল হক: আমার কথা হচ্ছে, রিট চলুক আর না-ই চলুক, ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি যত দূর জেনেছি, আমি যদি ভুল না জেনে থাকি, তাহলে বলি, রিটটা যে কারণে করা হয়েছিল, সেখানে যে ধরনের ইন্টেরিম অর্ডার (অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ) চাওয়া হয়েছিল, সেটা ছিল ফুল অর্ডারের (পূর্ণাঙ্গ আদেশ) মতোই। আর আমরা দেখি, রিলিফটা (প্রতিকার) পাওয়ার পরে নন-প্রসিকিউশনের (মামলা না চালানোর) জন্য রিটটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। এ কারণে আমি মনে করি, একজন আইনজীবী, আর তিনি যদি সিনিয়র হন, তাহলে তাঁর এটা বলা দায়িত্ব যে মাননীয় বিচারপতিকে এটা বলা যে এই প্রতিকার আপনি আমাকে দিতে পারবেন না। এটা আপনি আমাকে দেবেন না, এটাও বলার দায়িত্ব একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর।

প্রথম আলো: কিন্তু অন্য কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখি, রুল ইস্যু করার সময় কিছু প্রতিকার, যেমন রুল জারির আদেশেই ৫২টি ভেজাল খাদ্যপণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এল কেউ হয়তো বলবেন, হাইকোর্টের তো এই প্র্যাকটিস আছে যে রুল জারির সময় ইন্টারলোকেটরি অর্ডারে (অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ) একটা রিলিফ দেওয়া হয়।

আনিসুল হক: রিলিফ দেওয়া হয়, কিন্তু আপিল বিভাগ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, কখনোই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে ফুল রিলিফ (সম্পূর্ণ প্রতিকার) দেওয়া যায় না।

প্রথম আলো: এখানে তাহলে অর্থঋণ আদালতকে ডিক্রিটা (বাদী মিজানুর রহমানের পক্ষে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিপক্ষে) দিয়ে দিতে বলাটাই নজিরবিহীন হয়েছে?

আনিসুল হক: ডিক্রিটা দিতে হবে, এটাই হলো রিট পিটিশনের মূল বক্তব্য। রিট পিটিশনটা যদি শুধু ডিক্রি পেতেই করা হবে, তাহলে সেটা দুই পক্ষকে শুনে নিম্ন আদালত দিতে পারে কি না, এটা বিবেচনা করে, দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনার পরে রায় হবে। সুতরাং ডিক্রি পেতে হলে সেই পূর্ণাঙ্গ শুনানিসাপেক্ষ চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। এখানে ইন্টারলোকেটরি অর্ডার (অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ) দেওয়া উচিত ছিল না। আমি যে এই বক্তব্যটা দিচ্ছি, সেটা আরও সমর্থিত হয়, এই ঘটনায়, যখন আমরা জানি যে, নিম্ন আদালত ডিক্রিটা জারি করার পরে হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে মামলাটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। যারা প্রতিকার পেয়েছে, তারাই এসে বলেছে, মামলা চালাব না। তাহলে এটা কত বড় অন্যায়, এবার আপনিই বলেন?

প্রথম আলো: এই ঘটনায় হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে আদালত অবমাননার পৃথক একটি মামলা হয়েছিল, সেটা আপনি জানেন?

আনিসুল হক: হ্যাঁ, আমি জানি। তাই তো বললাম, এই ঘটনা দুঃখজনক।

প্রথম আলো: আচ্ছা, একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে, আপনি যেভাবে বলছেন যে দুঃখজনকভাবে সম্পূর্ণ প্রতিকার দেওয়া হয়েছে, সেটা কি ওই পৃথক বেঞ্চটির নজরে পড়ার কথা ছিল না কি?

আনিসুল হক: দেখুন, আপনি কিন্তু অনেক তথ্যের ভেতরে চলে যাচ্ছেন। আমি দেশের আইনমন্ত্রী, আমাকে একটু সাবধানে কথা বলতে হয়। আমার যা বোঝার তা হলো, যিনি কনটেম্পট পিটিশনের শুনানি করছেন, তিনি যেই বেঞ্চ রুল দিয়েছে, তাঁর থেকে তিনি কিন্তু সিনিয়র নন। এটা কিন্তু দেখতে হবে। যেহেতু একজন মাননীয় বিচারপতি আদেশটি দিয়েছেন, এখন সেই ডিসিপ্লিন ভেঙে কতটা করা সম্ভব, সেই প্রশ্ন কিন্তু আসে।

প্রথম আলো: আপনি কনভেনশনের জায়গা থেকে বলছেন?

আনিসুল হক: (সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে) তিনি হয়তো দেখেছেন, নিম্ন আদালত ইতিমধ্যে হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী ডিক্রি জারি করেছেন, এখন তাঁর কাছে এসেছে, কারণ নিম্ন আদালতের রায় অনুযায়ী সম্পত্তি হস্তান্তর করা হচ্ছিল না। সে ক্ষেত্রে তিনি সেটুকুই দেখেছেন। তাঁর থেকে সিনিয়র বিচারপতির পূর্ব আদেশ নিয়ে এই পর্যায়ে আর প্রশ্ন তুলবেন না, সেটাই স্বাভাবিক।

প্রথম আলো: আদালতের কাছে ‘পরিচ্ছন্ন হাতে’ আসার একটি বিষয় রয়েছে।

আনিসুল হক: নিশ্চয়ই, প্রবাদটি এ রকম যে ‘হোয়েদার হি হ্যাজ কাম উইথ ক্লিন হ্যান্ডস।’

প্রথম আলো: একই দরখাস্তকারী আগেও অন্য বিষয়ে আদালতে এসেছেন, সেখানেও নানা কথা আছে। আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল—

আনিসুল হক: আমি জানি, আমি সবই জানি। আমি অনেক কথাই বলব না। আমি যেটা বুঝতে পারছি, সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে, সেখানে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের যদি মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, তাহলে সেটা অত্যন্ত সিরিয়াসলি দেখা উচিত। অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। এটাই আমাদের সবার প্রিন্সিপাল হওয়া উচিত। আর না হলে, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যে কথাটি আমরা বলি, সেটা রক্ষায় আমরা যা করে যাচ্ছি, তা কিন্তু সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। সেই কারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করার জন্য এই সব ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সমাধান করতে হবে।

আর আপনি আমাকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলছেন, দেখুন, ষোড়শ সংশোধনী কিন্তু সেই জন্যই আনা হয়েছিল। সেই সংশোধনীর মূল কথাটিই ছিল, বিচারপতিরা একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁদের যদি কোনো মিসকন্ডাক্ট (অসদাচরণ) হয়ে থাকে বা তাঁদের যদি অসুস্থতা থেকে থাকে, তাহলে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের দ্বারা নির্বাচিতরাই সিদ্ধান্ত নেবেন যে বিচারপতিগণ দায়িত্ব পালনে সমর্থ কি না? হ্যাঁ, ষোড়শ সংশোধনীতে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ বিচারাধীন আছে। সে জন্য আমি সাব জুডিশ বিষয়ে কথা বলতে চাই না।

আনিসুল হক। ছবি : মিজানুর রহমান খান
আনিসুল হক। ছবি : মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: আপনারা রিভিউ করেছেন ঠিক, কিন্তু আপিল বিভাগ তাঁর রায়ের কার্যকরতা স্থগিত করেননি।

আনিসুল হক: স্থগিত হয়নি, কিন্তু আপনাকে একটা কথা বলি, ১৯৭২ সালে সংবিধানে যখন ৯৬ অনুচ্ছেদ ছিল, তখন সেখানে সাব আর্টিকেল ছিল ১,২, ৩ ও ৪। ১৯৭৭ সালে সংসদকে ছাড়াই যখন এর সংশোধন করা হলো, তখন সেখানে ১,২, ৩,৪, ৫,৬, ৭ ও ৮ সাব আর্টিকেল ঢোকানো হলো। যখন ওনারা রায় দিলেন যে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ, তখন ওনারা সাব আর্টিকেল ৮, যেখানে বিচারপতিদের পদত্যাগের কথা বলা আছে, সেটি কিন্তু তারা পুনরুজ্জীবিত করেননি। ষোড়শ সংশোধনীতে তাঁরা ১৯৭৭ সালের সংবিধানের ১ থেকে ৭টি উপদফা পুনরুজ্জীবিত করেছেন, ৮ উপদফাটি বাদ পড়েছে। সে ক্ষেত্রে এখন তাঁরা কী বিচার করবেন, আপনিই বলুন।

প্রথম আলো: আপনার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যেকোনো অভিযুক্ত বিচারক, তিনি চাইলেও পদত্যাগ করতে পারছেন না?

আনিসুল হক: নো।

প্রথম আলো: তার মানে একটা [সাংবিধানিক] অচলাবস্থা?

আনিসুল হক: সেই জন্যই আমি বলছি, ষোড়শ সংশোধনীর মামলাটার রিভিউর শুনানির প্রয়োজনটা এসে গেছে। আমি অ্যাটর্নি জেনারেলকে আগামী সপ্তাহেই বলব, শুনানি করার পদক্ষেপ নিতে।

প্রথম আলো: তাহলে আপনি আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করুন, যদি বিচারকেরা পদত্যাগ করতে না পারেন, তাহলে মহাহিসাব নিরীক্ষক, পিএসসি, নির্বাচন কমিশন, দুদক, মানবাধিকার ও তথ্য কমিশনার, সবার পদত্যাগের রাস্তা বন্ধ?

আনিসুল হক: [সংবিধানে ও আইনে ] যা বলা আছে, তাই। লেখা আছে, বিচারপতি যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেই রূপ পদ্ধতি ও কারণ ছাড়া তাঁরাও কেউ অপসারিত হবেন না। সুতরাং তাঁদেরও একই অবস্থায় রাখতে হবে। এটা তো পার্লামেন্ট করেনি।

প্রথম আলো: আপনি দাবি করছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত গোটা সাংবিধানিক স্কিমটাই অকার্যকর।

আনিসুল হক: এটা তো রিটেন ইন দেয়ার জাজমেন্ট, আমার মতামত কি?

প্রথম আলো: যদি সেটাই হবে, তাহলে সেটা শুধরে নিতে রাষ্ট্রের তেমন গরজ দেখছি কোথায়?

আনিসুল হক: আমরা সে জন্যই তো রিভিউ দরখাস্ত করলাম। এই একটি গ্রাউন্ডই তো যথেষ্ট। এরর ইন দ্য ফেস অব দ্য রেকর্ড। লিভ মঞ্জুরির জন্য তো এই একটি যুক্তিই যথেষ্ট। আর আমি তো বললাম যে, এর শুনানির জন্য আমি অ্যাটর্নি জেনারেলকে অনুরোধ করতে যাচ্ছি।

প্রথম আলো: তাহলে রাষ্ট্রপক্ষ এর শুনানির জন্য প্রস্তুত?

আনিসুল হক: জি, আমরা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।

প্রথম আলো: এই বিষয়ে আপনাদের একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে—

আনিসুল হক: না, প্লিজ, ডোন্ট পুট ওয়ার্ডস ইন মাই মাউথ। এখানে কোনো পলিটিকস নেই। আমি বলছি, রায় যেটা তাঁরা দিয়েছেন, সেটাকেই যদি গ্রহণ করি। রায়ের পরে এই বিষয়ে আমি যখন সরকারের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলাম, আপনি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন, আমি বলেছি, আমরা এই রায় মানি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমরা রিভিউ করব। সেই অবস্থান থেকে বলছি, এটা কোনো রাজনৈতিক মতামত নয়। আমি তাঁদের রায় সম্পর্কেই বলছি যে তাঁরা কী করেছেন। আমি কিন্তু রায় উপেক্ষা করতে পারি না। সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ হ্যাজ গিভেন এ জাজমেন্ট, এটা উপেক্ষা করার নয়।

প্রথম আলো: আপনার কথা সূত্রেই তাহলে বলতে হয়, ওই রায়ের মাধ্যমে আচরণবিধি সংশোধন করা হয়েছিল, আর সেখানে বিধান করা হয়েছিল যে বিচারকদের কারও বিষয়ে যদি অভিযোগ ওঠে, তাহলে প্রথমেই একটি পিয়ার কমিটি গঠন করতে হবে। এটা বাধ্যতামূলক। সুতরাং ওই রায় মতে, আপনার বর্ণিত দুঃখজনক ঘটনার তদন্ত এই কমিটিকেই করতে হবে। যেহেতু আপনি রায় মানছেন, তাই জানতে চাইব, আপনার মত কী?

আনিসুল হক: বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন। আমি কি সেটা বলে দিতে পারব, তাঁদের কী করা উচিত হবে। যদি লেখা থাকে, তাহলে নিশ্চয় ওনারা সেটা করবেন। এটাই আমি আশা করব। কিন্তু ওনাদের বলতে পারব না, এটা করেন।

প্রথম আলো: কিন্তু এটা বলুন, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সাবেক তিনজন অ্যাটর্নি জেনারেল কেন বিষয়টিকে রাষ্ট্রপতি মানে নির্বাহী বিভাগের কাছে ঠেলে দিচ্ছেন?

আনিসুল হক: না, নির্বাহী বিভাগের কাছে ঠেলছেন না। আমার মনে হয়, ব্যাপারটা হচ্ছে, তাঁরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে দিচ্ছেন। রাষ্ট্রপতি কিন্তু বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ বা আইনসভা—কারও নয়। তিনি সবার অভিভাবক এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী।

প্রথম আলো: কিন্তু রায়ের পরে পুনরুজ্জীবিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রথম বৈঠকে সংশোধিত আচরণবিধি সবাইকে মেনে চলার নির্দেশ দিয়ে উভয় বিভাগের বিচারকদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পরিষ্কার লেখা, অভিযোগ এলে রাষ্ট্রপতির নজরে নেওয়ার আগে তাঁরা প্রাথমিকভাবে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করবেন। অভিযুক্ত বিচারককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবেন। এই প্রক্রিয়ার লিখিত রেকর্ড থাকবে।

আনিসুল হক: দেখুন, রিভিউ শেষ হওয়ার আগেই তাঁরা তড়িঘড়ি করে একটা সভা করেছিলেন। সেটা কতটা আইনসিদ্ধ, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাই এর মধ্যে আমি যাব না। এখন একটি ঘটনা ঘটেছে। এখন মাননীয় প্রধান বিচারপতির একটি দায়িত্ব বর্তেছে। আমি বিশ্বাস করি, তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি। অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তি। সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এ রকম একটি বিষয় যদি তিনি দেখেন, তাহলে নিশ্চয়ই এটার ব্যাপারে একটা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। আমি আশা করব, সেই ব্যবস্থাটা তিনি তাড়াতাড়ি নেবেন।

প্রথম আলো: সাবেক প্রধান বিচারপতির [এস কে সিনহা] পরে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের যে বার্ষিক প্রতিবেদন ছেপেছেন, তাতে সংবিধানের বিদ্যমান ৯৬ অনুচ্ছেদ হিসেবে কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধানটাই আছে।

আনিসুল হক: হতে পারে। আমি তো বললাম, যতক্ষণ পর্যন্ত রিভিউ পিটিশনটি নিষ্পত্তি না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত। এখন আপনি যদি ওখানে দেখেন, ৯৬ অনুচ্ছেদ আছে, আবার উল্লিখিত উপদফা ৮ আছে, তাহলে তো তা ঠিক হবে না। হবে? এটা তো ঠিক হবে না। আমি ওটার মধ্যে যেতে চাই না, তার একটিই কারণ, আমাদের রিভিউ সাবজুডিশ। খবরের কাগজেই দেখলাম, আদালত একটি নির্দেশনা দিয়েছেন, সাবজুডিশ বিষয়ে কথা না বলতে। অন প্রিন্সিপাল, আমি কখনোই তা বলি না। ১৬ মে যে মামলায় আপিল বিভাগে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যেটা বহুল আলোচিত ব্যাপার, সেই বিষয়ে আমি শুধু বলতে চাই, মাননীয় বিচারপতি যিনি এটা করেছেন, তাঁর একটা দায়বদ্ধতা আছে। তাঁর একটা জবাব দিতে হবে এবং যিনি বিজ্ঞ আইনজীবী, যিনি এর সঙ্গে ছিলেন, তাঁকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আমরা যদি সেটা করতে পারি, বিচার বিভাগের মর্যাদা বাড়বে, কমবে না। আমাদের মনে হয় যে সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এই কাজটি করবেন।

প্রথম আলো: প্রয়াত শ্রদ্ধেয় আইনজীবী সিরাজুল হকের যে নীতির কথা বলেছেন, সেটা আইনজীবীদের আচরণবিধিতে পরিষ্কার লেখা আছে। যেটা বলেছে, আইনজীবী মীমাংসিত বিচারিক নীতিকে তর্কিত করা বা আইনের ভুল ব্যাখ্যা দেবেন না। তাই বার কাউন্সিলের করণীয় আছে কি না?

আনিসুল হক: নিশ্চয়ই করণীয় আছে। সেখানে নালিশ থাকলে, সে বিষয়ে তাঁরা করবেন। আইনমন্ত্রী হিসেবে বললে বার কাউন্সিলকে এটা করতেই হবে। কিন্তু আমি বলব, এসব ঘটনায় বার কাউন্সিলের একটা ভূমিকা থাকে। যেমন বিচারপতির ব্যাপারে আপিল বিভাগেরও একটা দায়িত্ব আছে। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি।

প্রথম আলো: হাইকোর্ট প্রশাসন ইদানীং মিডিয়ায় ‘বিচারাধীন বিষয়ে’ খবর দেখে উদ্বিগ্ন, তাঁরা এক বিজ্ঞপ্তিতে ‘অনুরোধ’ করেছেন বিরত থাকতে। সুপ্রিম কোর্টের ল রিপোর্টার্স ফোরাম বলেছে, তাঁরা মর্মাহত। কারণ, তাঁরা সাব জুডিস রুল মেনেই সাংবাদিকতা করছেন।

আনিসুল হক: আমি বলব, কোর্টে বিচারাধীন মামলা আছে, কিন্তু তার কার্যক্রম চলছে না। সেই বিষয়ে শুধু প্রেস কেন, যদি যে কেউ মন্তব্য করেন, তাহলে সেটা সাবজুডিশ বিষয় হয় না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার চলাকালে উভয় পক্ষের আইনজীবীরা যা যুক্তিতর্ক দিচ্ছিলেন, সেটাই রিপোর্টেড হয়েছিল। শুনানিকালে বিচারকদের করা প্রশ্নও মিডিয়ায় এসেছে। কিন্তু যে মামলার বিচার কার্যক্রম চলমান সে বিষয়ে যদি মতামত দিতে থাকি তাহলে বিচার পাওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে একটা সন্দেহ তৈরি হয়, বিজ্ঞ বিচারকদের ওপর একটা সাংঘাতিক চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপ যাতে না হয়, সে জন্য ন্যায়বিচারের স্বার্থে কথা বলা সমীচীন নয়।

প্রথম আলো: কিন্তু অর্থঋণ আদালতসংক্রান্ত ওই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরে মিডিয়া লিখেছে।

আনিসুল হক: আমি এই রকম তথ্যাদির মধ্যে ঢুকতে চাই না। এটা ঠিক সাবজুডিশ ম্যাটারে কথা বলা উচিত নয়। কারণ, তাহলে বিচার প্রভাবিত হতে পারে। আর ল রিপোর্টার্স ফোরাম যেটা বলেছে, সেখানেও যুক্তি আছে। কিন্তু একটা লাইন ক্রস করা উচিত নয়, সেটা হলো মামলাটা কোন পর্যায়ে আছে। শুনানি চলছে নাকি শুনানি হচ্ছে না। মামলাটি কোন পর্যায়ে আছে, সেটা বিবেচনা করা উচিত।

প্রথম আলো: আমাদের প্রধান বিচারপতিদের অংশগ্রহণে গৃহীত ল্যাটিমার হাউস বা বেঙ্গালুরু নীতিমালা আমাদের দেশেও প্রযোজ্য, এসব আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটেছে কি না?

আনিসুল হক: আমি আবারও বলব, একটি সাবজুডিশ বিষয়ে আমার এ বক্তব্য হবে একটি রায়, সেটা আমি দেব না।

প্রথম আলো: এই মামলাটি তো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আপিল বিভাগ নিম্নআদালত ও হাইকোর্টের সব রায় বাতিল করেছেন।

আনিসুল হক: আমি কিন্তু বলব, নিষ্পত্তি হয়নি। তার কারণ, এই মামলার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্ন যতক্ষণ না নিষ্পত্তি হয়, তাই আমার চোখে এই মামলা নিষ্পত্তি হয়নি।

প্রথম আলো: আপনি মনে হয়, [হাইকোর্ট বেঞ্চ] আচরণের বিষয়টিকে সাবজুডিশ বলছেন!

আনিসুল হক: ইয়েস। দ্য ভেরি জাজমেন্ট হ্যাজ বিকাম কন্ট্রোভার্সিয়াল অ্যান্ড ইট ইজ কোশ্চেনেবল। তাই এখন যদি কেউ বলে মামলাটি শেষ হয়ে গেছে, শেষ হয়নি। (হাসি) এটা হচ্ছে, সেই রকম, শেষ হইয়াও শেষ হইল না।

প্রথম আলো: ছোট গল্প বলতে পারেন। কিছুটা হয়তো। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ওয়েবসাইট বলছে, ‘ডিসপোজড অফ’। বলুন এর কী অর্থ?

আনিসুল হক: মামলা শেষ হয়েছে, সেটা তো আমি বলছি। মাননীয় আপিল বিভাগ বলেছেন, অবৈধ যা ঘটেছিল, সেসব বাতিল হয়ে গেছে। যা ইলিগ্যাল, তা সেটঅ্যাসাইড হয়ে গেছে। তবে ওই মামলাকে ঘিরে আজকে যে প্রশ্ন উঠেছে, মাননীয় বিচারপতির কন্ডাক্ট সম্পর্কে যে প্রশ্ন উঠেছে, উঠেছে তো? সেগুলো তো এখনো শেষ হয়নি। আর সেসব তো এই মামলার বাইরে নয়। এসব প্রশ্নগুলো যখন নিরসন করা হবে, তখন এই মামলাটি কিন্তু আলোচনায় আসবে। আমি যদি আজ আপনার প্রশ্নের জবাব দিই, তাহলে এই মামলার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

প্রথম আলো: সিনিয়র আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী প্রমুখ আজ সমস্বরে বলছেন, এই আদেশ ‘প্রিপস্টারাস’ (অস্বাভাবিক)।

আনিসুল হক: কোনটা প্রিপস্টারাস?

প্রথম আলো: হাইকোর্ট বেঞ্চের আদেশ।

আনিসুল হক: নিশ্চয়ই। এটা বেআইনি। আপিল বিভাগই তো সেটা করে দিয়েছেন। আর আমার তো বলার কী আছে?

প্রথম আলো: আমরা সাধারণত সবকিছুতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুটো লেন্স দিয়ে দেখি। এবারেই বিরল দৃশ্য দেখলাম, সবাই একমত।

আনিসুল হক: আমি একে সাধুবাদ জানাই। আমরা সবাই আইনের শাসন চাই এবং যাঁদের কথা বললেন, তাঁরাও তা চান। তাঁদের ধন্যবাদ জানাই যে এ বিষয়ে তাঁরা আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। বিচার বিভাগের মর্যাদা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তাই যখনই বিচার বিভাগের সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রশ্ন আসে, তখন আমাদের চোখে জল আসে। সে জন্য আমরা মনে করি, বিচার বিভাগের মর্যাদা রাখার জন্য বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ব্যবস্থা নেবেন।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

আনিসুল হক: ধন্যবাদ।