আহ, টসটসে লিচু!

গাছে গাছে ঝুলছে টসটসে লিচু। এটি মোজাফ্ফর জাতের লিচু। বৈশাখের শেষ সপ্তাহ থেকে এই লিচু সংগ্রহ শুরু হয়। ছবিটি গুরুদাসপুরের বেড়গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আনিসুর রহমান
গাছে গাছে ঝুলছে টসটসে লিচু। এটি মোজাফ্ফর জাতের লিচু। বৈশাখের শেষ সপ্তাহ থেকে এই লিচু সংগ্রহ শুরু হয়। ছবিটি গুরুদাসপুরের বেড়গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আনিসুর রহমান

গাছে গাছে লাল টসটসে লিচু। ভারে মাটি ছোঁয়া অবস্থা। সেসব লিচু সংগ্রহ করে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আড়তে। অনেকে আবার ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দাম হাঁকছেন। সব মিলিয়ে কাঠফাটা রোদে রসাল এই ফলকে ঘিরে জমে উঠেছে নাটোরের গুরুদাসপুরে লিচুর পাইকারি মোকাম। দুপুরের পর থেকে শুরু হয় পাইকার, ফড়িয়া আর বিক্রেতাদের হাঁকডাক।

উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়ঙ্গারামপুর কানুব্যাপারীর বটতলার চিত্র এটি। ওই মোকাম এলাকায় প্রায় চার হাজার বিঘা জমিতে মোজাফ্ফর জাতের আগাম লিচুর আবাদ হয়। বৈশাখের শেষ সপ্তাহ থেকে এই লিচু সংগ্রহ শুরু হয়।

লিচু যেন মাটি ছুঁই ছুঁই। লিচু পরিপক্ব হয়েছে কি না, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। ছবিটি গুরুদাসপুরের বেড়গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আনিসুর রহমান
লিচু যেন মাটি ছুঁই ছুঁই। লিচু পরিপক্ব হয়েছে কি না, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। ছবিটি গুরুদাসপুরের বেড়গঙ্গারামপুর এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আনিসুর রহমান

লিচু আড়তদার সমিতির সভাপতি মো. সাখাওয়াত হোসেন মোল্লার তথ্যমতে, এখানে লিচুর ১৫টি আড়ত গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন গড়ে ৩০-৪০ ট্রাক লিচু (প্রতি ট্রাকে ২০০ ঝুড়ি, এক ঝুড়িতে ২ হাজার ২০০টি লিচু থাকে) এখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই মোকামের কর্মকাণ্ড। জুনের প্রথম সপ্তাহেই শেষ হয়ে আসে এই লিচু।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল করিম জানান, এই লিচুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আগামজাত, সংখ্যায় বেশি ধরে, পোকার আক্রমণ কম হয়, সুস্বাদু ফলের ৬০ ভাগ রসালো (খাদ্য উপযোগী) আর ৪০ ভাগ ফেলনা (আঁটি) এবং শতভাগ ফরমালিনমুক্ত। বাগান থেকে সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর কারণে চাহিদা অনেক বেশি। ওই কর্মকর্তার তথ্যমতে, এবার ৪০৯ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। গত বছরের চেয়ে ১০ হেক্টর বেশি। এ বছর ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হয়েছে; যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা।

পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক সালাম মোল্লা, আবদুর রশিদসহ অন্তত ১০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে ঝড় ও শিলাবৃষ্টির কারণে লিচুর ফুল ও গুটি কিছুটা নষ্ট হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে লিচুর আকার-আকৃতি বড় হয়েছে। লিচুতে দাগ ও ফেটে যাওয়ার হারও অনেক কম এ কারণে গত বছরের তুলনায় প্রতি হাজারে ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে।

যেসব লিচুবাগান ব্যবসায়ীরা আগেই কিনে নেন, সেসব লিচু পাড়ার পর বাগানেই চলে ঝুড়িতে ভরার কাজ। ছবি: আনিসুর রহমান
যেসব লিচুবাগান ব্যবসায়ীরা আগেই কিনে নেন, সেসব লিচু পাড়ার পর বাগানেই চলে ঝুড়িতে ভরার কাজ। ছবি: আনিসুর রহমান

কৃষক সালামের ভাষ্যমতে, তিনি এক একর জমিতে লিচুর বাগান করেছেন। প্রতি বিঘায় ১২টি করে লিচুগাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছে গড়ে পাঁচ হাজার লিচু ধরেছে। বর্তমান গড় বাজার দর ১ হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হবে। পক্ষান্তরে প্রতি বিঘায় তাঁর খরচ গুনতে হয়েছে সার,কীটনাশক ও শ্রমিক বাবদ ১৫ হাজার টাকা। খরচ বাদে বিঘা প্রতি লাভ হচ্ছে ৭৫ হাজার টাকা। তা ছাড়া লিচুর বাগানে সাথি ফসল কূলবরই, হলুদ, মুগডাল আবাদ করেও বাড়তি লাভবান হচ্ছেন তিনিসহ এলাকার শত শত লিচু বাগানমালিক।

গতকাল শনিবার নাজিরপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন লিচুবাগান ঘুরে দেখা গেছে, গাছে গাছে লাল টসটসে লিচু ঝুলছে। লিচুর ভারে ডালপালাগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থা। বাগান থেকে লিচু সংগ্রহ করছে শ্রমিকেরা। সেসব লিচু ঝুড়িতে ভরে ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাইকারি আড়তে। গুরুদাসপুরসহ আশপাশের উপজেলার বাগান থেকে লিচু এসে জমা হচ্ছে এখানে।

উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়গঙ্গারামপুর কানুব্যাপারীর বটতলার চিত্র এটি। ওই মোকাম এলাকায় প্রায় চার হাজার বিঘা জমিতে আগাম লিচুর আবাদ হয়। ছবি: আনিসুর রহমান
উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বেড়গঙ্গারামপুর কানুব্যাপারীর বটতলার চিত্র এটি। ওই মোকাম এলাকায় প্রায় চার হাজার বিঘা জমিতে আগাম লিচুর আবাদ হয়। ছবি: আনিসুর রহমান

মক্কা-মদিনা, হাজি ফলভান্ডার, ভাইভাই ফলভান্ডার, দেশ ফলভান্ডার ঘুরে জানা গেল, প্রতি হাজার লিচু রকমভেদে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। বাগান থেকে আনা লিচু উন্মুক্ত ডাকে তোলা হয়। সেখান থেকে সর্বোচ্চ দরে পাইকার-ফড়িয়ারা কিনে নেন। এরপর লিচুগুলো আড়তে স্তূপ করে রাখা হয়। সেখান থেকে শ্রমিকেরা তা প্যাকেট করছেন ট্রাকে ওঠানোর জন্য।

কথা হয় সিলেটের বাদামতলি থেকে আসা ‘মা-বাবা ফলভান্ডার’র প্রতিনিধি রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, সাত বছর ধরে এই মোকাম থেকে লিচু কিনে সিলেটে বিক্রি করেন। প্রতিদিন তিনি দেড় থেকে দুই লাখ লিচু কিনে থাকেন। এই লিচু তিনি সিলেটে নিয়ে প্রতি হাজারে গড়ে ৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা লাভে বিক্রি করবেন। তাঁর মতে, এখানকার লিচু আকার, রং-স্বাদ—সবই ভালো।

চলছে দামের হাঁকডাক। প্রতি হাজার লিচু রকমভেদে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। ছবি: আনিসুর রহমান
চলছে দামের হাঁকডাক। প্রতি হাজার লিচু রকমভেদে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। ছবি: আনিসুর রহমান

একই রকম তথ্য জানালেন শ্রীমঙ্গলের ‘মৌসুমি ফলভান্ডারের প্রতিনিধি সোনামিয়া, ঢাকার মিরপুর কাজীপাড়ার ‘মানিক ফলভান্ডার’, যাত্রাবাড়ীর ‘বিক্রমপুর ফলভান্ডার’, চৌরাস্তা বিশ্বরোডের ‘বিক্রমপুর ফলভান্ডার’‍-এর প্রতিনিধিরা।

মোকাম থেকে ট্রাকে করে এই লিচু চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়। ছবি: আনিসুর রহমান
মোকাম থেকে ট্রাকে করে এই লিচু চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলায়। ছবি: আনিসুর রহমান

তবে ঢাকার বাদামতলির রিফাত এন্টারপ্রাইজের প্রতিনিধি আশরাফুল ইসলাম জানালেন ভিন্ন তথ্য। তাঁরা আড়ত থেকে কোনো লিচু কেনেন না। লিচু গাছে ফুল আসার পর পরই এলাকায় এজেন্ট নিয়োগ করে প্রায় কোটি টাকা দাদন দিয়ে থাকেন। তাঁদের নিযুক্ত এজেন্টরা বাগানমালিকদের কাছ থেকে কম টাকায় বাগান কিনে থাকেন। লিচু সংগ্রহ করে তাঁদের আড়তে নিয়ে বাজারমূল্য হিসেবে মূল্য পরিশোধ করে থাকেন। লগ্নি করা টাকার সুদ গড়ে ৫-১০ শতাংশ হারে কেটে নেওয়া হয়। এভাবে তাঁরা ৩০-৪০টি বাগান কিনে নিয়েছেন। এসব বাগানের লিচু সংগ্রহ করতে বেড়ঙ্গারামপুর কানুব্যাপারির বটতলার মোকামের প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মোল্লাবাজার পয়েন্টে পৃথক আড়ত খুলেছেন। সেখান থেকে প্রতিদিন চার-পাঁচ ট্রাক করে লিচু তাঁদের ঢাকার মোকামে নিয়ে যাচ্ছেন।