'স্তালিন' নাটকে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ

নতুন মঞ্চনাটক ‘স্তালিন’-এ ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনেছে দর্শকের একটি অংশ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে জাতীয় নাট্যশালায় নাটকটি দেখে নির্দেশক কামালউদ্দিন নীলুর ওপর চড়াও হন একদল দর্শক। নাটক শেষে তাঁরা×একযোগে প্রতিবাদ করেন। স্লোগান দেন নাট্যশালার করিডরে। তাঁদের দাবি, নাটকে স্তালিনকে ভয়ংকর, অমানবিক, একরোখা ও নির্দয় হিসেবে দেখানো হয়েছে।

তাঁদের প্রশ্ন, স্তালিন কেন এত নিষ্ঠুর? কেন কাছের মানুষকেও হত্যা বা বন্দী করার নির্দেশে তিনি অবিচল? দর্শকের এই অংশের দাবি, একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে টাকা খেয়ে স্তালিনকে এভাবে নেতিবাচক চরিত্রে দেখানো হয়েছে।

নাটকের বিরতির সময়ই মৌন প্রতিবাদ শুরু হয়। এ সময় নাট্যকর মামুনুর রশীদকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। পরে নাটক শেষে তা সশব্দে প্রতিবাদে পরিণত হয়। গতকাল রাতে অন্তত ১৫ মিনিট চিৎকার ও স্লোগান চলে মিলনায়তনে এবং নাট্যশালার করিডরে।একপর্যায়ে থিয়েটার অঙ্গনের কয়েকজনের জ্যেষ্ঠ কর্মীর হস্তক্ষেপে তা থামে। আজ বুধবার বিকেল পাঁচটায় জাতীয় নাট্যশালার সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেন প্রতিবাদকারীরা। এ সময় তাঁরা ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান, পুঁজিবাদের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’সহ নানা রকম স্লোগান দিতে থাকেন।

জাতীয় নাট্যশালায় গতকালের প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরা, শহিদুজ্জামান সেলিম, চন্দন রেজা, সুবচন নাট্যদলের প্রধান আহমেদ গিয়াসসহ অনেকে।

আহমেদ গিয়াস প্রথম আলোকে জানান, ‘যারা প্রতিবাদ করেছে, তাদের আমরা চিনতে পারিনি। তারা থিয়েটার অঙ্গনের কেউ না। সম্ভবত কোন দলের বা কোন মতাদর্শের।’ তিনি আরও বলেন, ‘নাট্যকর্মীদের জন্য নাটক বন্ধ হওয়া খুব কষ্টের। তবে আমি মনে করি, এর দায়ভার শিল্পকলা একাডেমিকে নিতে হবে। কেন এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ নাটক জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হবে। কেন দিনের পর দিন এই ধরনের দল বরাদ্দ পাবে।’

যোগাযোগ করা হলে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী প্রথম আলোকে বলেন, হল বরাদ্দের জন্য একটি কমিটি আছে, যে কমিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মহাপরিচালকের কিছু করার থাকে না। আর কোন নাটক প্রদর্শিত হবে বা হবে না, সেটা আগে থেকে বাছাই করা মানে নিয়ন্ত্রণ করা। সেই নিয়ন্ত্রণ আমাদের কারওই কাম্য না। সবারই মতপ্রকাশের অধিকার আছে।’

নাট্যকার মান্নান হীরা নাটকটি দেখেছেন। প্রতিবাদের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, এ নাটকে চরমভাবে ইতিহাসের বিকৃতি হয়েছে। স্তালিনকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই বলে নাটক বন্ধ করার পক্ষে আমি নই। দর্শক নাটক দেখবে এবং সত্যকে আবিষ্কার করার দায়িত্ব দর্শকের। মতামত প্রকাশ করার অধিকার সবার থাকা উচিত।’

‘স্তালিন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি প্রথম আলো
‘স্তালিন’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি প্রথম আলো

গতকাল রাতের ঘটনার পর নাটকের নির্দেশক কামালউদ্দিন নীলুর সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, আমি মনে করি, এটাই থিয়েটারে শক্তি, একটা শিল্প কতটা শক্তিশালী হলে এটা সম্ভব! আমি মনে করি, এটা নিয়ে এভাবে প্রতিবাদ না করে আলোচনা–বিতর্ক হতে পারত।’ তাঁর দাবি, নাটকের কোনো কিছুই বানানো বা তাঁর নিজের কল্পনাপ্রসূত না।

নাটকটির পাণ্ডুলিপি তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সাইমন সিব্যাগ মন্টিফিওরের ‘স্তালিন: দ্য কোর্ট অব দ্য রেড জার’, স্ভেৎলানা অ্যালিলুয়েভার ‘অনলি ওয়ান ইয়ার’ ও ‘টোয়েন্টি লেটার্স টু আ ফ্রেন্ড’, ডেভিড পিনারের ‘দ্য টেডি বিয়ার্স পিকনিক’ এবং রোজমেরি সুলিভানের ‘স্তালিন্স ডটার’ থেকে।

এখানে কামালউদ্দিন নীলু নিজে কোনো কিছু বানিয়ে লেখেননি। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই। আলোচনা, তর্ক–বিতর্কে যেতে রাজি আছি।’

গত সোমবার সন্ধ্যায় সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) মঞ্চে এনেছে ‘স্তালিন’। যেখানে স্তালিনকে দেখানো হয়েছে একজন গণনায়ক ও কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে। নাটকে উঠে এসেছে এমন এক সময়ের গল্প, যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়োসেফ স্তালিন। তিনি মনে করতেন—মৃত্যুই সব সমস্যার সমাধান, মানুষ না থাকলে সমস্যাও থাকবে না।

নাটকের শুরুতে আইজেনস্টাইনের একটি সিনেমা দেখছিলেন স্তালিন। সেটি দেখার মাঝপথে স্তালিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ঘটনাটি ঘটে স্তালিনের বাগানবাড়িতে। সেখানে তিনি ডেকে পাঠান তাঁর পলিটব্যুরোর সদস্যদের। যদিও সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন স্তালিনের মেয়ে স্ভেৎলানা, তাঁর সেক্রেটারি আলেকসান্দর পসক্রেবিশেভ ও দেহরক্ষী মেজর ভ্লাসিক। কিন্তু পলিটব্যুরোর সদস্যরা উপস্থিত হওয়ার আগে সেখানে উপস্থিত হন স্তালিনের গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর প্রধান নিকোলাই ইয়েঝভ। স্তালিনকে তিনি একটি তালিকা ধরিয়ে দেন, যাতে তিনি লিখে এনেছেন পলিটব্যুরোর সদস্যদের মধ্যে কাকে কাকে ছাঁটাই করতে হবে।

এরপর নিকোলাই ইয়েঝভ চলে যান এবং উপস্থিত হন স্তালিনের পলিটব্যুরোর সদস্য ক্রুশ্চেভ, মলোতভ, মালেনকভসহ কয়েকজন। স্তালিন তাঁদের সঙ্গে রাজনীতির এক জটিল ও নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠেন এবং স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে তিনি একের পর এক মৃত্যুপরোয়ানা জারি করতে থাকেন। তার একসময়কার সহকর্মী নিকোলাই বুখারিনকে গ্রেপ্তার করেন এবং লোকদেখানো বিচারকাজ চালিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। এদিকে তাঁর আরেক সহকর্মী ট্রটস্কি নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁকেও মেরে ফেলার জন্য তাঁর গুপ্ত পুলিশ বাহিনীর প্রধান নিকোলাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়। স্তালিনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে বাক্‌স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়। তিনি মায়ারহোল্ডকে গ্রেপ্তার করেন। তারপর তাঁকে প্রচণ্ড নির্যাতন করেন এবং মৃত্যুদণ্ড দেন। স্তালিনের এই নিষ্ঠুরতার কারণে পলিটব্যুরোর সদস্যরা সব সময় মৃত্যুভয়ে ভীত থাকেন। ফলে, স্তালিনের চারপাশে তৈরি হয় চাটুকারের দল। স্তালিন তাঁর পৈশাচিক আচরণ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সহকর্মীদের কাছ থেকে তো বটেই, পরিবারের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়া ছেলেকে ফিরিয়ে আনার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি স্তালিন। এ কারণে মেয়ে স্ভেৎলানার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। আর এভাবেই স্তালিনের মতো একজন একনায়ক জীবনসায়াহ্নে পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।