জনতার ডাক্তার বসন্ত কুমার

বাড়ির ফটকের ওপর ছোট একটি সাইনবোর্ড সাঁটা। সাদা রঙে তাতে লেখা, ‘ডা. বসন্ত কুমার রায়’। নামের নিচে আরেকটু ছোট হরফে লেখা, ‘এমবিবিএস’। তারপর উল্লেখ আছে রোগী দেখার সময়, এলাকার নাম। ১৯ জুন সেই বাড়িতে যখন পৌঁছাই, ঘড়ির কাঁটা তখন ১১টা ছুঁই–ছুঁই। দিনাজপুর শহরের কালীতলা এলাকার তিনতলা ভবনের এই বাড়ির নিচতলায় লম্বালম্বি ছোট একটি বারান্দা। সঙ্গেই লাগোয়া একটি ঘর। ঘর আর বারান্দায় পাতা বেঞ্চে বসে আছেন জনা ত্রিশেক নারী। যাঁদের অনেকের কোলেই বিভিন্ন বয়সী শিশু। ‘ওয়া’, ‘ওয়া’ শব্দে কয়েকটি শিশুর কান্নার শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে বৈদ্যুতিক পাখার শব্দের সঙ্গে।

চিকিৎসক বসন্ত কুমার রায়। ছবি: মাসুদুল হক
চিকিৎসক বসন্ত কুমার রায়। ছবি: মাসুদুল হক

ঘরে তখন বসার জন্য একটি আসনই ফাঁকা। সেই আসনেই মিনিট পাঁচেক পর এসে বসলেন ডা. বসন্ত কুমার রায়। ৮১ বছর বয়সী এই চিকিৎসক চলনে–বলনে এখনো যেন ৩০ বছরের তরুণ। দিনাজপুর ও আশপাশের জেলার মানুষের পরিচিত মুখ তিনি। পরিচিত বলেই বসন্ত কুমার রায়ের রোগী দেখার জন্য নামমাত্র ফি আর আন্তরিক সেবার কাহিনি অনেকের জানা। তরুণ চিকিৎসক হিসেবে শুরুটা করেছিলেন মাত্র ২ টাকা ভিজিটে। এখন তা ৪০ টাকা। যাঁদের সাধ্য নেই তাঁরা চিকিৎসাসেবা পান বিনা পয়সায়। আবার এমনও অনেকে আসেন, যাঁদের ওষুধও কিনে দেন নিজের পয়সায়।

বসন্ত কুমার রায় যখন সিরিয়াল মেনে রোগী দেখছিলেন, এই সুযোগে আমরা কথা বলেছিলাম অপেক্ষমাণ সাবিনা আক্তারের সঙ্গে। চার বছরের অসুস্থ নাতিকে নিয়ে বিরল উপজেলার দারোইল থেকে এসেছেন এই নারী। একসময় মেয়ে শারমিন আক্তারকেও এই ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসতেন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে, নাতি হয়েছে কিন্তু চিকিৎসক বদল হয়নি সাবিনার। তাঁর মতো সেখানে অপেক্ষমাণ প্রায় প্রত্যেককে দেখেই বোঝা যায় নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। বসন্ত কুমারের কাছেই কেন আসেন তাঁরা?

সাবিনা আক্তারের পাশেই ছিলেন চিরিরবন্দর উপজেলার বেলতলী থেকে আসা জেসমিন। শিশুকে শান্ত করতে করতে বলছিলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। ভিজিট দিতে পারি না। বসন্ত ডাক্তার ছাড়া কার কাছে দেখাব?’ শুধু যে নামমাত্র ফি বলেই তাঁরা এখানে ভিড় করেন, এমনও নয়। অনেকেই বলছিলেন, অনেক সময় নিয়ে, দরদ দিয়ে রোগী দেখেন ডাক্তার বসন্ত।

কিছুক্ষণ পর রোগীর ভিড় যখন কমে এল, আলাপের সুযোগ হলো বসন্ত কুমার রায়ের সঙ্গে। জীবনের খাতা মেলে ধরলেন বসন্ত কুমার রায়। কথায় কথায় এল ভিজিটের বিষয়ও। বসন্ত রায় বললেন, ‘জীবনে বেঁচে থাকতে হলে খুব বেশি টাকার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। মানুষের সেবা করার যদি লক্ষ্য থাকে, তাহলে জীবনে সার্থকতা ধরা দেবেই। একটা ভালো কাজের জন্য সময় বা জীবনযাত্রার মান এ বিষয়গুলো বড় নয়, বড় হলো ত্যাগের মনোভাব, সেবার মানসিকতা।’

তাই তো তিনি ১৯৬৭ সালে রোগী দেখা শুরু করেন ২ টাকায়। সেটা বেড়ে ৫৩ বছর পর হয়েছে ৪০ টাকা। বসন্ত রায় বলছিলেন, ‘তখন ২ টাকাও অনেক কিছু। অনেকের কাছে সেই দুই টাকাও থাকত না। তখন ফ্রি দেখতাম, এখনো কিন্তু অনেকের কাছে ফি নিই না। হয়তো তার ছেলেকে নিয়ে এসেছে দেখাতে, সেও একসময় আমার রোগী ছিল। আবার একেবারে হতদরিদ্র মানুষ এসেছে। কীভাবে টাকা নিই?

’তাঁর প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। আমরা বরং ডুব দিই তাঁর চিকিৎসক জীবনের শুরুর দিনগুলোতে। ‘১৯৬৫ সালে আমি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। এলাকার মানুষের জন্য কিছু করব বলেই ফিরে আসি বাড়িতে।’ বলছিলেন বসন্ত কুমার রায়।

বসন্ত কুমার রায়ের চেম্বারের রোগীর ভিড় লেগেই থাকে
বসন্ত কুমার রায়ের চেম্বারের রোগীর ভিড় লেগেই থাকে

তৎকালীন দিনাজপুর জেলার (বর্তমান পঞ্চগড়) দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদীঘি গ্রামে বসেই যেন তিনি পণ করে বসেন সরকারি চাকরি না করার। তিনি মানবসেবার এই পথের সন্ধান পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। ছাত্রজীবনেই দিনাজপুরে রামকৃষ্ণ মিশনে যাতায়াত ছিল তাঁর। এমবিবিএস পাসের পর সেটা আরও যেন বেড়ে যায়। তিনি বললেন, ‘সে সময় রামকৃষ্ণ মিশনের দায়িত্বে ছিলেন মহারাজ অমৃতানন্দ। মূলত তাঁর সংস্পর্শে এসেই স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত হয়ে পড়ি।’ ভক্ত বসন্ত কুমার রায় শুরু করেন স্বামী বিবেকানন্দের জীবনচর্চা। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন মানবসেবায়।

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসাসেবা প্রদান করার সিদ্ধান্তে অবাক হননি বসন্ত কুমার রায়ের বাবা মধুসূদন রায় আর মা অহল্যা বালা রায়। পাঁচ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে বসন্ত কুমার যে ছোটবেলা থেকেই খানিকটা অন্য রকম, তিনি যে এমন কিছুই করবেন, তা যেন পরিবারের সদস্যদের জানাই ছিল! তাই তাঁর প্রতি আস্থাই রেখেছিলেন মা-বাবা। মানুষের সেবার মাধ্যমে বসন্ত কুমার তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। নিজের আদর্শে ছোট ভাই অরুণ কুমারকে চিকিৎসক বানিয়েছেন। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দুজন বাবার মতো চিকিৎসক হয়েছেন, অন্যজন রয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়।

স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত বসন্ত কুমার মুহূর্তেই অন্যকে আপন করে নিতে পারেন। মানুষকে আপন করে নেন বলেই হয়তো খানিকটা স্মৃতিকাতুরেও। তাই কথায় কথায় ফিরে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে, বন্ধুদের কথায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার বলরাম ক্যাম্পে চিকিৎসক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়ার স্মৃতিতে।

কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়া এই মানুষটা সদাহাস্যোজ্জ্বল বন্ধুবৎসল। জীবনে অবসর বলে কিছু নেই তাঁর কাছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যান বাড়ির ছাদে। ফুল, ফল আর ভেষজ সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ রকমের গাছ ৪০০ টবে লাগানো রয়েছে। বাড়ির ছাদে ছোট ছোট মাচাংয়ে দুলছে করলা-চিচিঙ্গা। গাছে ধরেছে লেবু, ডালিম, করমচা। গোলাপ, গাঁদা, মালতী, দোপাটি, রজনীগন্ধাসহ বেশ কিছু ফুল যেন ভিন্ন সুরে গান তুলেছে। সপ্তাহের দুই দিন রেলবাজার আর বাহাদুর বাজার হাটে গিয়ে সামান্য বাজার করা, বাগানের পরিচর্যা আর সময় করে রোগী দেখা (বেলা ১১টা-২টা, সন্ধ্যা ৬টা-রাত ৮টা), এই নিয়ে তারুণ্যের দীপ্তিতে ৮১ বছর পার করতে চলেছেন বসন্ত কুমার রায়। জানালেন, যে কদিন বাঁচবেন, তার পুরোটাই এই রুটিনেই থাকতে চান তিনি।

বসন্ত কুমার সম্পর্কে দিনাজপুর নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বললেন, ‘শিশুদের জন্য উপযুক্ত একজন চিকিৎসকের নাম বসন্ত কুমার। আমার দুই ছেলেমেয়ে (মেয়ের বয়স ৪৪ এবং ছেলের ৩৬ বছর)। এসএসসি পাস করার আগে পর্যন্ত সন্তানদের যেকোনো অসুখবিসুখে বসন্ত কুমারের কাছেই নিয়ে যেতাম। তখন তাঁর ভিজিট ছিল তিন টাকা। দীর্ঘ সময় ধরে চিকিৎসাসেবায় সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি।’