ল্যাম্বরগিনির কারিগর
তিনি বলিউড সিনেমা খুব যে দেখেন, এমনটা নয়। তবে টিভির রিমোট হাতে এ চ্যানেল-ও চ্যানেল ঘুরে হিন্দি গানেও কিছুটা সময় চোখ রাখেন। সেদিনও এমনই এক সিনেমার গানে দৃষ্টি ছিল। রাজা নটবরলাল সিনেমার সেই গানের একটি মুহূর্তে নায়ক এমরান হাশমিকে আবিষ্কার করেন একটি রঙিন গাড়িসমেত। গানটা সেদিন যতটা না মনে ধরেছিল, তার চেয়ে ঢের ধরেছিল সেই ছাদ খোলা ছিমছাম গাড়িটা।
২০১৪ সালের গল্প এটি। আকাশ আহমেদ নামের ২৩ বছরের সেই তরুণ আগ্রহ নিয়ে তাঁর স্বপ্নের গাড়ি সম্পর্কে জানলেনও। ইতালির বিলাসবহুল স্পোর্টস কার ‘ল্যাম্বরগিনি’ এটি। দরদাম জেনে নিজেকেই হয়তো বোঝালেন, এ তো রীতিমতো ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’। কিন্তু তিনি থামলেন না, ল্যাম্বরগিনি কেনা যেহেতু সম্ভব হবে না, সংকল্প করলেন—নিজেই বানাবেন দামি গাড়িটির আদলে একটি বাহন। বানালেনও তাই! সেই গাড়ির সুবাদে তিনি যেন এখন ল্যাম্বরগিনি আকাশ!
সেই গাড়িতে বসেই আকাশ শোনাচ্ছিলেন গল্পটা, ‘আমি নিজে নিজে গাড়ি বাড়ানোর সাহস করেছিলাম আমাদের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তৈরির কারখানার কল্যাণে। এখানেই ধীরে ধীরে কাজটি করেছি।’
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পশ্চিমপাড়া এলাকায় আকাশদের সেই ‘নবী অ্যান্ড সন্স’ নামের কারখানাটি। যার মূল কারিগর আকাশ নিজেই। কারখানার কারিগর হয়েছেন পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলে যাওয়ায় ইতি টানেন। কাজ নেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ে একটি জাহাজ নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে। সেখানে তিনি দেড় বছর ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করেন। সেটা ছেড়ে রাজধানীর শ্যামপুরে বাংলাদেশ রেলওয়ের ভারতীয় ট্রেন লাইনের বার তৈরির কাজও করেছেন। এরপর ২০১৬ সালে ফিরে আসেন নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জে, সেখানেই মামা আবুল হোসেনের অটোরিকশা ওয়ার্কশপে অটোরিকশা তৈরির ডাইস, হাইড্রোলিক বডি প্রেস তৈরিসহ নানা কাজ শেখেন। এরপর নিজের কারখানা।
২০১৮ সালে সেই কারখানাতেই গাড়ির কাজ শুরু করেন। বাবা নবী হোসেন ছেলের কাজের উৎসাহী মনোভাব দেখে তাঁকে টাকাও দেন। সেই টাকা দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ির আসন, চাকাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জোগাড় করা শুরু করেন। এরপর শুরু হয় ল্যাম্বরগিনি আদলে গাড়ি তৈরির প্রচেষ্টা।
ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে ল্যাম্বরগিনির আদলে গাড়ির নকশা বানান। জাহাজ কাটার অভিজ্ঞতা থেকে ইস্পাতের পাত কেটে গাড়ির কাঠামো তৈরি করেন। গাড়িতে যুক্ত করেন ১২০০ ওয়াটের একটি মোটর, ১২ ভোল্টের ৫টি ব্যাটারি, স্টিয়ারিংটি ল্যান্সার গাড়ির, গিয়ার বক্স মিতসুবিশি গাড়ির—এভাবে বিভিন্ন গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ যুক্ত করতে থাকেন গাড়িতে। ড্যাশবোর্ড, সাউন্ড সিস্টেম, বাতিসহ নানা কিছু যুক্ত হতে থাকে। আকাশ বলছিলেন, ‘গাড়ির চাকা আর স্টিয়ারিং হুইলটাই কেবল কিনে আনা হয়েছে, অন্য সব যন্ত্র হাতে তৈরি। চাকার সাসপেশন, হেডলাইট, ব্যাক লাইট, গিয়ার—এসবও আমার তৈরি, যা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না।’
দেড় বছরের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা সরঞ্জামে গাড়িটি তৈরি করেন আকাশ। এখন তাঁর গাড়িটি ৫ ঘণ্টা চার্জ দিলে ৫০ কিলোমিটার গতিতে প্রায় ১০ ঘণ্টা চলতে সক্ষম। আকাশ আহমেদ বলেন, ‘গাড়িটি তৈরি করতে এ পর্যন্ত তিন লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। প্রথমে আমি যখন গাড়ি তৈরি করা শুরু করি, তখন অনেকেই হাসাহাসি করত। এখন তারাই আমার প্রশংসা করে। এটা আমার কাছে অনেক ভালো লাগে।’
জৈব জ্বালানিবিহীন বলেই আকাশের গাড়িটি পরিবেশবান্ধব। আকাশ যোগ করলেন, ‘দামেও
সাশ্রয়ী। সহযোগিতা পেলে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে চাই এ রকম গাড়িটি।’