পাপেটে রত্নার জীবনের গল্প

‘স্বামী আর শাশুড়ি ছাদে আছাড় মারেন। কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে যাই। আস্তে আস্তে কানে আসে ‘মনে হয় বাঁচব না, কী করবি? বাঁচায় রাখলে কিন্তু বিপদ হইব। চল, ছাদ থেইক্যা ফালায় দেই।’ ‘মা-ছেলের এসব কথা আমি শুনছি, কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। ওপরে তুইল্লা ধাক্কা মেরে যখন ফেলে দিল, আমি তো আর নাই।’ হুইলচেয়ারে বসে এভাবেই কথাগুলো বললেন রত্না আক্তার ওরফে নদী।

রত্না আক্তার ও নওশাবা আহমেদ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
রত্না আক্তার ও নওশাবা আহমেদ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

২০১৫ সালের মার্চ মাসের ঘটনা এটি। হুইলচেয়ারে বসে কথা বলতে বলতেই রত্নার মুখে হাসির রেখা। কেননা রত্নার জীবনের গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে পাপেট থিয়েটার ‘মুক্তি আলোয় আলোয়’। এই পাপেট থিয়েটারে অংশ নিয়েছেন হুইলচেয়ার নিয়ে জীবন চালানো একদল নারী-পুরুষ।

ক্র্যাচে ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন রত্না আক্তার। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
ক্র্যাচে ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন রত্না আক্তার। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

রত্নার মুখে এবার দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। জানালেন আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) সহায়তায় সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের (সিআরপি) হুইলচেয়ার নারী বাস্কেটবল দলের তিনি একজন সদস্য। এই খেলার সুবাদে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে যান নেপাল। ইন্দোনেশিয়ায় আরেকটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার নারী হুইলচেয়ার বাস্কেট বল দলকে পাঁচ ম্যাচ সিরিজে হারিয়ে শিরোপা জিতে আসে দলটি।

সম্প্রতি সিআরপিতে হুইলচেয়ার বাস্কেট বল দলের এক প্রশিক্ষণ শেষে রত্না কথা বলেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তিনি জানালেন, ছোট বেলায় নানির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় এক বখাটের অত্যাচার এবং সমাজের চাপে তাঁর সঙ্গেই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েতে রত্নার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই রত্নাকে শাশুড়ি পছন্দ করেননি।

শ্বশুরবাড়িতে রত্নার জন্য বরাদ্দ ছিল চাল থেকে বের হওয়া খুদের ভাত। চুরি করে ভাত খেয়ে ফেলাসহ নানা ছুতোয় শাশুড়ি তাঁর ছেলেকে দিয়ে মার খাওয়াতেন। মাঝেমধ্যে মা ও ছেলে মিলে মারতেন। এমনকি সন্তান পেটে থাকা অবস্থাতেও সন্তান নষ্ট করে ফেলার জন্য মারতেন। একপর্যায়ে বাড়ি থেকে রত্না ও তাঁর স্বামীকে বের করে দেওয়া হয়। অনেক দিন পর আবার বাড়ি ডেকে নেন শাশুড়ি। তবে নির্যাতন থামেনি।

স্বামী বিদেশ যাবেন এই অজুহাতে রত্নাকে বাবার বাড়ি থেকে এক লাখ টাকা আনার জন্য চাপ দিতে থাকেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এরপর এই টাকার জন্যই রত্নাকে এমন মারধর করা হয় যে তাঁর জীবনটাই হুইলচেয়ারে বন্দী হয়ে যায়। সাতক্ষীরায় দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর রত্না সিআরপিতে ভর্তি হন। এখানে ভর্তি থাকা অবস্থাতেই বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুযোগ পান।

হুইলচেয়ার নারী বাস্কেটবল দলের সদস্যরা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
হুইলচেয়ার নারী বাস্কেটবল দলের সদস্যরা। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

বাস্কেট বল খেলে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এখন সন্তান নিয়েই রত্নার সংসার। স্বামী আরেক বিয়ে করেছেন। স্বামী ও শাশুড়ির নামে মামলা করলেও তা শেষ পর্যন্ত থেমে যায়। রত্নার এই সংগ্রামী জীবনকে নিয়েই নির্মিত হচ্ছে ৫২ মিনিটের পাপেট থিয়েটার ‘মুক্তি আলোয় আলোয়’। এটি রচনা করেছেন এজাজ ফারাহ, আর পরিচালনা করেছেন কাজী নওশাবা আহমেদ।

নওশাবা আহমেদ বলেন, তাঁর টুগেদার ইউ ক্যান দল প্রতিষ্ঠা এবং রত্নার জীবনের গল্প নিয়ে পাপেট শো করার গল্প। ৬ জুলাই সন্ধ্যা সাতটায় ছায়ানট মিলনায়তনে দ্বিতীয়বারের মতো মঞ্চায়ন হতে যাচ্ছে পাপেট শোটি। এতে সার্বিক সহযোগিতা করছে  ব্রিটিশ কাউন্সিল ও সিআরপি।

নিজের জীবনে দুবার দীর্ঘ সময় হুইলচেয়ারে জীবন কাটানো এবং মানসিক শক্তি জয়ের গল্প শোনালেন নওশাবা। চারুকলা থেকে পড়াশোনা করা নওশাবা মূলত অভিনয়শিল্পী হিসেবে পরিচিতি। তবে তিনি দীর্ঘ সাত বছর সিসিমপুরের ইকরির চরিত্রে অভিনয় করেছেন অর্থাৎ তাঁর হাতেখড়ি পাপেট দিয়ে। এক দুর্ঘটনায় এই পাপেট থেকে দূরে থাকতে হচ্ছিল তাঁকে, তবে তিনি ভুলতে পারতেন না।

বাস্কেটবল মাঠে অন্যদের সঙ্গে রত্না আক্তার। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
বাস্কেটবল মাঠে অন্যদের সঙ্গে রত্না আক্তার। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

কাজী নওশাবা আহমেদ বললেন, ‘বছরের শুরুতে মানসিকভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ হলে একটু প্রশান্তি পেতে ছুটে যাই সিআরপির ভ্যালরি এ টেলরের কাছে। হুট করেই তিনি জানতে চান আমি তাঁদের জন্য কী করতে পারি? আমার মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে আমি জীবনে আর কিছু করতে পারব, সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ভেলরি একটু সময় দিলেন। তাঁদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন, দেখলাম। হুইলচেয়ারে বসা নারী ও পুরুষের বাস্কেটবল খেলা দেখে বুঝতে পেলাম, তাঁদের মানসিক শক্তি অনেক বেশি। তাৎক্ষণিকভাবে মনে হলো আমি পাপেট নিয়ে কিছু করতে পারব।’

নওশাবা জানালেন, ঘটনাচক্রে ব্রিটিশ কাউন্সিল নারী ও কিশোরীদের ক্ষমতায়নের অগ্রগতিতে বৈশ্বিক আন্দোলন সৃষ্টিতে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়াও ফাউন্ডেশনের অংশীদারত্বে ঢাকায় প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ‘উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড—ওয়াও’ ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করে। সেখানে কিছু একটা করার জন্য আমন্ত্রণ জানায় তারা। এরপরই টুগেদার ইউ ক্যান দলের যাত্রা শুরু হয়। শুরু হলো রত্নার জীবনী জানা। ওয়াও’ ফেস্টিভ্যালে প্রথম মঞ্চায়ন হয় রত্নার জীবনী। জীবনের সত্য ঘটনা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই পাপেট শো। শোর একদম শেষে রত্না উপস্থিত হন দর্শকের সামনে। রত্নার কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠা অর্থাৎ পুরো জীবন দেখানো হয় ৫২ মিনিটের শোতে।

‘মুক্তি আলোয় আলোয়’ পাপেট থিয়েটারে অংশ নিয়েছেন হুইলচেয়ার নিয়ে জীবন চালানো একদল নারী-পুরুষ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
‘মুক্তি আলোয় আলোয়’ পাপেট থিয়েটারে অংশ নিয়েছেন হুইলচেয়ার নিয়ে জীবন চালানো একদল নারী-পুরুষ। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

‘আমার জীবনে শক্তির প্রয়োজন ছিল। আমি রত্নাদের কাছ থেকে সেই শক্তি পেয়েছি। পাপেট শোটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হতে যাচ্ছে জনগণের আর্থিক সহায়তায়। অনেকেই এগিয়ে আসছেন, তবে একটি শো করার জন্য যে পরিমাণ আর্থিক সংস্থান দরকার, তা এখনো আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। তবে আমরা আশাবাদী, নিশ্চয়ই মানুষ এগিয়ে আসবে’- বললেন নওশাবা।

পাপেট শো নিয়ে রত্না বলেন, ‘আমি এখন ক্রাচ দিয়ে একটু হাঁটতে পারি। আমার মতো রত্নার জীবনী নিয়ে নওশাবা আপা কাজ করছেন, তা ভালো লাগে। আমার গল্প সবাই দেখছেন, জানছেন। আমি বলতে চাই, ঘরে-বাইরে আমার মতো আর কোনো রত্নার যেন জন্ম না হয়। তবে এটাও বলতে চাই, আমরা নারী, আমরাও ঘুরে দাঁড়াতে পারি।’