পিপলস লিজিং অবসায়ন হচ্ছে

কার্যক্রম শুরুর ২২ বছরের মধ্যে এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে অবসায়নে পাঠাতে হচ্ছে সরকারকে। এ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেখভালের দায়িত্বও ছিল এ সংস্থার। তদারকি দুর্বলতা ও পরিচালকদের অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন দেউলিয়া। এমন অবস্থা আরও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পিপলস লিজিংকে অবসায়নের পক্ষে সম্মতি দিয়েছে সরকার। এখন আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়নে উচ্চ আদালতে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আদালতের আদেশেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। এ জন্য ইতিমধ্যে একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংকে অবসায়নে অনুমোদন চেয়েছিল। আমরা অবসায়নের অনুমতি দিয়ে মতামত পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে কোম্পানিটি অবসায়নে পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’

এর আগে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে (বিআইএফসি) অবসায়নেও সরকারের মতামত চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকার তাতে কোনো মতামত দেয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। করলে প্রতিষ্ঠানটির এমন পরিণতি হতো না। সময়মতো পর্ষদ ভেঙে দিলে এত খারাপ অবস্থা হতো না। এখন যা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা ভালো। এতে সাময়িক ক্ষতি হলেও পুরো আর্থিক খাতের জন্য ভালো হবে। সবাই সচেতন হবে।

বর্তমান আর্থিক অবস্থা

জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের থেকে মেয়াদি আমানত ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম প্রদান করে আসছিল। গত ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ছিল ২ হাজার কোটি টাকা। পিপলসের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপিই ৭৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের হার ৬৬ শতাংশ। ২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিক লোকসান গুনছে প্রতিষ্ঠানটি।

পিপলসের আমানতের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। প্রায় ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহকদের আমানত রয়েছে ৭০০ কোটি টাকা। খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আদায় করতে না পারায় আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। আবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা তো দূরের কথা, সুদও দিতে পারছে না। আর ভাবমূর্তি–সংকটে পড়ে নতুন তিন বছরের বেশি সময় ধরে আমানত আসা বন্ধ হয়ে গেছে।

গত রোববার মতিঝিলের সিটি সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন আমানতকারী টাকা তোলার অপেক্ষা করছেন। পিপলসের কর্মকর্তারা তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছেন, টাকা আদায় হলেই দেওয়া হবে। কিন্তু কবে দেওয়া হবে, তার কোনো দিনক্ষণ বলতে পারছেন না। এর কারণ জানতে চাইলে পিপলসের কর্মকর্তারা জানান, টাকার অভাবে তাঁদের বেতনই সঠিক সময়ে হচ্ছে না। গ্রাহকদের টাকা কীভাবে ফেরত দেবেন।

পিপলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি হুদা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি ছোট অঙ্কের আমানত ফেরত দেওয়ার। ঋণের টাকা আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

যত অনিয়ম, জড়িত যাঁরা

জানা যায়, ২০১০ সাল পর্যন্ত পিপলস লিজিং দৃশ্যত ভালোই চলছিল। এরপর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকেরা নামে–বেনামে টাকা বের করে নেন। এর অনেক পর তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আসে। এরপর কয়েকজন পরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেন পরিচালকেরা। এর বড় অংশই বের করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সামসুল আলামিন গ্রুপের নামে। গ্রুপের ২০ প্রতিষ্ঠান এবং কয়েকজন পরিচালকের নামে অনিয়ম করে বের করা হয় ১৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া পরিচালক মতিউর রহমান, খবির উদ্দিন, ইউসুফ ইসমাইল, বিশ্বজিত কুমার রায়ও নামে–বেনামে টাকা বের করে নেন। এর মধ্যে সামসুল আলামিন গ্রুপ প্রায় ১০০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। আর কেউ যোগাযোগও করছেন না। পিপলসের সাবেক চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন প্রতিষ্ঠানটির ১২৩ কোটি টাকার জমি নিজের নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে নিলেও পরে তা ছেড়ে দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব অনিয়ম বের হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি থেকে পরিচালক সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন, হুমায়রা আলামিন ও খবির উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। আর চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন।

সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর সামসুল আলামিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে টাকা নিয়েছিলাম, তার বড় অংশই শোধ করা হয়েছে। যে টাকা বাকি আছে, তা দিয়ে দেওয়া হবে। আমরা যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন প্রতিষ্ঠানটি ভালো ছিল। কেন এমন হলো, তা বলতে পারব না।’

পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে একটি পক্ষ। এ কারণে আমি চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিই। এরপর পিপলস থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। কোনো সংস্থা এতে মনোযোগ দেয়নি। এ কারণে আজ অবসায়নের চিন্তা করতে হচ্ছে।’

তথ্য অনুযায়ী, ছয় খেলাপি গ্রাহকের কাছেই পিপলস লিজিংয়ের পাওনা রয়েছে ২৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল হ্যাচারি ও কর্ণপুর অ্যাগ্রোর কাছে ৪৭ কোটি টাকা, নাহার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিংয়ের কাছে ৬২ কোটি টাকা, এলাইড সোলার এনার্জির ১১ কোটি টাকা এবং ইন্ট্রাকো সিএনজির কাছে পাওনা ১৯ কোটি টাকা। এর মালিকানায় আছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এম এম হাকিম আলী ও তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা হাকিম আলী। মনোয়ারা হাকিম আলী এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি। এ ছাড়া নিরীক্ষকদের সংগঠন দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলামের কাছে পিপলসের পাওনা আট কোটি টাকা।

আইনে যা আছে

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে নিয়োজিত হলে ও আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করতে পারবে। ২৯ ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের ভিত্তিতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের জন্য আদেশ প্রদান করতে পারবেন। যদি ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয় ও ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয় । এদিকে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) নীতিমালা অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে অবসায়ন হলে সরকারি গেজেটে আদালতের আদেশের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। আদালত এক বা একাধিক ব্যক্তিকে অবসায়ন প্রক্রিয়ার জন্য অবসায়ক (লিকুইডেটর) নিয়োগ দিতে পারেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নে আইন অনুযায়ী সরকারের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে সম্পদের চেয়ে দেনা বেশি হলে সরকারকেই দায় শোধ করতে হবে। এ জন্যই সরকারের অনুমোদন নিতে হয়েছে।