আটঘরের নৌকার হাটে

সন্ধ্যা নদীর শাখা আটঘর কুড়িয়ানা খাল। পেয়ারা ও কৃষিপণ্যে ভাসমান হাটের জন্য আটঘর খালের পরিচিতি রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে আটঘর খালের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাসমান হাট জমজমাট হয়ে ওঠে। এ খালে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার বসে ডিঙি নৌকার হাট। 

পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্ব দিকে আটঘর বাজার। বছরের জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের নৌকার সবচেয়ে বড় হাট বসে এখানে।
গত শুক্রবার ভোরে পিরোজপুর থেকে মোটরসাইকেলে চেপে রওনা হলাম আটঘর খালের নৌকার হাটের উদ্দেশে। স্বরূপকাঠি বাজার পার হয়ে পূর্ব দিকে আটঘর হাটের পথ ধরতেই চোখে পড়ল, ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে খাল বেয়ে হাটে যাচ্ছেন নৌকা তৈরির কারিগরেরা। কেউ ট্রলারে করে অনেকগুলো নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন হাটে।

সকাল আটটায় হাটে গিয়ে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। সেখানে আধা কিলোমিটারজুড়ে সড়ক ও খালের দক্ষিণ প্রান্তে সারি সারি ডিঙি নৌকা। রাখা হয়েছে বিক্রির জন্য। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দরদাম করে পছন্দের নৌকা কিনে বাড়ি ফিরছেন। কেউ নৌকা বেয়ে আবার কেউ ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে তুলে নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। স্থানীয় কৃষক, জেলে ও গৃহস্থরা ছাড়াও বরিশালের বানারিপাড়া, উজিরপুর, ঝালকাঠি সদর উপজেলা, রাজাপুর উপজেলা ও পিরোজপুরের কাউখালী, নাজিরপুর উপজেলা থেকে নৌকা কিনতে মানুষ এ হাটে আসে।
বানারিপাড়া উপজেলার উমারেরপাড় গ্রামের জহিরুল ইসলাম পেশায় নৌকা ব্যবসায়ী। তিনি প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নৌকা কেনাবেচা করেন। বললেন, নেছারাবাদ উপজেলার ডুবি, কাটাখালী, একতা, চামী গ্রামে কয়েক শ পরিবার নৌকা তৈরি করে। হাটের দিন ভোরে গ্রাম থেকে নৌকা তৈরির কারগিরদের কাছ থেকে নৌকা কিনে ট্রলারে করে হাটে নিয়ে বিক্রি করেন। বেচাকেনা ভালো হলে প্রতি হাটে ৩৫ থেকে ৪০টি নৌকা বিক্রি হয়। প্রতি নৌকায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। আবার কখনো লোকসানও গুনতে হয়।

হাটে নৌকা কিনতে আসা ঝালকাঠি সদর উপজেলার সিরজুক গ্রামের আবু হানিফা বলেন, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে তিনি আটঘর হাটে নৌকা কিনতে আসেন। কৃষিকাজ ও মাছ ধরার জন্য নৌকা কেনেন। একটি নৌকায় এক বছর ব্যবহার করা যায়।
ষাট বছর ধরে নৌকা তৈরি করে বিক্রি করেন গোপাল বিশ্বাস। তিনি জানালেন, শত বছর ধরে আটঘরে নৌকার হাট বসে আসছে। বাপ-দাদার আমল থেকে এখানে হাট বসে। ধীরে ধীরে হাটের ব্যাপ্তি বেড়েই চলছে।
নেছারাবাদ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওয়াহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আটঘর কুড়িয়ানা খালের ভাসমান পেয়ারা ও নৌকার হাট দেখতে পর্যটকেরা আসেন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সম্প্রতি আটঘর কুড়িয়ানা এলাকার পেয়ারা বাগান ও ভাসমান হাট ঘুরে গেছেন। তিনি দর্শনার্থীদের জন্য এখানে একটি ডাকবাংলো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে নৌকার বিকিকিনি। তবে সকাল ১০ থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হাট জমজমাট থাকে। নৌকার পাশাপাশি হাটে বইঠাও বিক্রি হচ্ছে।
নেছারাবাদ উপজেলার সন্ধ্যা নদীর পশ্চিমপাড়ের গ্রাম ডুবি, কাটাখালী, একতা ও চামী গ্রাম। গ্রামগুলোর তিন শতাধিক পরিবার নৌকা তৈরির পেশায় জড়িত। একসময়ে সুন্দরী কাঠ সহজলভ্য ছিল। তখন সুন্দরী কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি হতো। মূলত সুন্দরী কাঠ সহজলভ্য হওয়ায় এ এলাকার গ্রামগুলোতে নৌকা তৈরির প্রচলন শুরু। এখন সুন্দরী কাঠ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় কড়াই, চম্বল ও মেহগনি কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়। বর্ষা মৌসুমে গ্রামগুলোতে গিয়ে চোখে পড়ে বাড়ির আঙিনায় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগরেরা।