মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতু এখনো ভরসা

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুতে তীব্র যানজট। একমুখী এ সেতুতে যানজটের এ ভোগান্তি নিত্যদিনের। সেতুর পশ্চিম পাশের প্রান্তে, গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টায়। ছবি: সৌরভ দাশ
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুতে তীব্র যানজট। একমুখী এ সেতুতে যানজটের এ ভোগান্তি নিত্যদিনের। সেতুর পশ্চিম পাশের প্রান্তে, গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টায়। ছবি: সৌরভ দাশ

কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট রেলসেতুটি নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয় ১৯১৪ সালে। সে সময় ব্রিটিশরা  বার্মায় সৈন্য আনা-নেওয়ার কাজে এটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৩০ সালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। ১৯৭১-এ সেতুটির উত্তর ও পশ্চিম পাশে ঘাঁটি করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল মুক্তিবাহিনী। ৯০ বছর বয়সী মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুটির এখন মরণদশা। তবু ঝুঁকি ও ভোগান্তি মাথায় নিয়ে দিনে প্রায় ১ লাখ লোক এই সেতু ব্যবহার করে যাচ্ছে।

একমুখী কালুরঘাট সেতুর স্থানে নতুন করে একটি দ্বিমুখী সড়ক ও রেলসেতু নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয়রা। সর্বশেষ গত মাসে অনশন করেন বোয়ালখালীর মুক্তিযোদ্ধারা। ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন সেতুর বিষয়ে সুরাহা না হলে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণাও দেন স্থানীয় সাংসদ মইন উদ্দীন খান বাদল। সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আবদুল মোমিন বলেন, ‘রেলসেতু হলে আমাদের কোনো লাভ হবে না।’

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, পূর্ব পটিয়া, দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া, শহরের চান্দগাঁও ও মোহরা এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ এই সেতুর ওপর নির্ভরশীল। কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম পাশ (শহর এলাকা) থেকে বোয়ালখালী সদর গোমদন্ডির দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। কিন্তু ১০ মিনিটের এই পথ যেতে এখন সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। সেতুতে ওঠার জন্য সব সময় দুদিকে গাড়ির দীর্ঘ সারি থাকে।

মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় রেলওয়ে সেতুটিকে ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। এরপর ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) একদল গবেষকও এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দেয়। সেতুর পূর্বপাশে দুটি সাইনবোর্ড দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। একটিতে লেখা ‘১০ টনের অধিক মালামাল পরিবহন নিষেধ।’ অপরটিতে লেখা, ‘এই সেতুর ওপর দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচল নিষেধ। আদেশ অমান্যকারীকে ফৌজদারিতে সোপর্দ করা হবে।’

এসব বিধিনিষেধ কিছুই মানা হচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন পারাপার করে তেমনি অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই ট্রাকও চলছে। সেতুর মাঝপথে গাড়ি বিকল হয়ে গেলে অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়।

গত সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার ঘটনা। পশ্চিম পাশ (শহরের দিক) থেকে গাড়ি সেতুতে উঠে গেছে। সেতুর মাঝামাঝি গিয়ে একটি ট্রাক বিকল হয়ে পড়ে। সেতুর ওপর বাস, ট্রাক, টেম্পো, অটোরিকশা, মাইক্রোবাস ঠাঁইয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে দোহাজারীগামী ট্রেন এসে সেতুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

তীব্র গরমে অতিষ্ঠ যাত্রীদের কয়েকজন গেটকিপার নূর হোসেনের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়। কেন ভারী ট্রাক সেতুতে উঠতে দিল এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি। এক যাত্রী বলেন, ‘ন ফাইল্লে ছঁরি ছাড়ি দে। তোরে হনে হইয়ে ওভারলোড ট্রেরাক তুলিবারল্লে। (কে বলেছে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই ট্রাক তুলবার জন্য। না পারলে চাকরি ছেড়ে দে।)’

এভাবে আধঘণ্টা পর ট্রাকটি সচল করলে গাড়ি চলাচল পুনরায় শুরু হয়। এবার সেতুর ওপরের গাড়ি পার হওয়ার পর ট্রেন ছোটে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আধঘণ্টার অচলাবস্থার প্রভাব তখন সেতুর দুপাশে। এক পাশের গাড়ি শেষ হতেই আধঘণ্টা সময় পার।

৭৩ গর্ত

সরেজমিনে দেখা যায়, রেল সেতুটির স্থানে স্থানে ছোট–বড় গর্ত। কোথাও হাড়গোড় উঠে গেছে। পশ্চিম থেকে পূর্ব পাশ পর্যন্ত গুনে ৭১টি গর্ত পাওয়া যায়। গর্তে ট্রাক পড়লে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে পুরো সেতু।

সেতুতে ক্ষত এত ভয়াবহ যে গর্তের ভেতর থেকে নদীর পানি দেখা যায়। আর রেলিংয়ের নিচের কাঠ ভেঙে গেছে অন্তত ১০ স্থানে।

সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে পার হচ্ছিলেন পশ্চিম পাশের দোকানি বোয়ালখালীর বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘ও ভাই ফরান আতত লইয়ারে চলির দে। হঁত্তে ভাঙি ফরে আল্লা জানে।’

নাজুক অবস্থার কথা স্বীকার করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন বলেন, ‘সেতুটির বয়স হয়েছে। ট্রেন চলাচলে সমস্যা নেই। যত সমস্যা বড় গাড়িতে। আমরা ১০ টন বেঁধে দিয়েছি। কিন্তু ৩০ থেকে ৪০ টন নিয়ে গাড়ি চলছে।’

এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন একটি যাত্রীবাহী ট্রেন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত দুবার করে যাওয়া–আসা করে। এ ছাড়া দোহাজারী বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল পরিবহন করে অপর একটি মালবাহী ট্রেন। তবে ফার্নেস তেলের ওজনে সমস্যা হয় না বলে দাবি প্রধান প্রকৌশলীর।

জোড়াতালিতে চলছে

এ সেতু বারবার সংস্কার-মেরামত করে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতুতে বড় ধরনের সংস্কার কাজ করা হয়। এ সময় ১১ মাস সেতুর ওপর যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। গত বছর জাহাজের ধাক্কায় একটি স্প্যান সরে যায়। ওই সময় দুদিন বন্ধ রেখে তা ৫০ লাখ টাকায় মেরামত করা হয়। এর আগে একাধিক দফায় সেতুর সংস্কার করা হয়।

প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুক্তগীন বলেন, ‘লোহার সেতু ৬০ বছরে বেশি ব্যবহার করা ঠিক নয়। তারপরও আমরা এখনো ব্যবহার করছি। এখন মেরামতের জন্য নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। নতুন একটি দ্বিমুখী রেল সেতুর জন্য সমীক্ষা চলছে।’

সেতুর গুরুত্ব

বোয়ালখালী ও পটিয়ার তিন ইউনিয়নের প্রায় ২০ লাখ মানুষ এই সেতুর ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। এ ছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটের গাড়িও এই সেতু দিয়ে বিভিন্ন সময় চলাচল করে। সেতুর পূর্ব পাড়ে বোয়ালখালী অংশে প্রায় ৫০টি কলকারখানা রয়েছে। সেতু নড়বড়ে হওয়ায় এসব কারখানা পণ্য পরিবহন করতে পারে না। তারা তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু (শাহ আমানত সেতু) ব্যবহার করে। এতে খরচ বাড়ে।

স্থানীয় সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বলেন, এখন রেল সেতু করার কথা হচ্ছে, যেটিতে সড়ক সংযোগ নেই। এটা হলে জনগণের উপকার হবে না।