জল থইথই হাকালুকি

.
.

তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টিতে আষাঢ় তার চেনা চেহারায়। মৌলভীবাজার-বড়লেখা সড়কের কাঁঠালতলিতে গিয়েই থামতে হলো। সকালবেলার বৃষ্টির জল পাথারিয়া পাহাড় বেয়ে নিচে নামছে। সড়কে হাঁটুপানি। গাড়ি এই চলে তো, এই আবার চলে না। সাধারণত এই সড়কের বড়লেখা উপজেলা সদরের পাখিয়ালা থেকে হাকালুকি হাওরের দিকে যেতে হয়। কিন্তু জলজট হঠাৎ বৃষ্টির কারণে।
অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য পথে ছুটতে হলো হাকালুকি। পথ সরু হলেও পাকা। আঁকাবাঁকা পথটির অনেক স্থানই ভেঙেচুরে গেছে। আগরবাতি-আতরের জন্য খ্যাত বড়লেখার সুজানগর পার হয়ে হয়ে একসময় গাড়ি গিয়ে থামল তালিমপুর ইউনিয়নের হাল্লা গ্রামে। যেখানে পাকা পথ শেষ। এবার পা বাড়াতে হবে কাঁচা রাস্তায়। থকথকে কাদায় পথ পিচ্ছিল। পথের ওপর কচুরিপানা ছড়ানো-ছিটানো। হয়তো বর্ষার জলে ডুবেছিল। গ্রামের এই মেঠো পথ ধরে একটু দক্ষিণে এলেই চোখভরা মায়ার জল। থইথই করে নাচছে হাকালুকি।
হাকালুকি ভ্রমণের এই যাত্রায় আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন সাংবাদিক। সমকাল-এর নুরুল ইসলাম, এসএ টিভির পান্না দত্ত, ইনডিপেনডেন্ট টিভির আব্দুর রব, যমুনা টেলিভিশনের আহমদ আফরোজ এবং কুলাউড়ার সেলিম আহমদ। তাঁরা এসেছেন হাকালুকিতে ইলিশের খোঁজে। কদিন থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফলাও করে খবর ছাপা হচ্ছিল, হাকালুকি হাওরে ধরা পড়ছে ইলিশ। সেই ইলিশের ছবি তোলা হবে। ‘অন এয়ারে’ ঘরে ঘরে পৌঁছাবে হাকালুকির সেই ইলিশ। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বললে কেউ কেউ ইলিশ পাওয়ার খবর শুনেছেন জানালেন। হাল্লা গ্রামের আব্দুল লতিফসহ কয়েকজন জানালেন, এটা নতুন কিছু না। বর্ষায় হাকালুকি হাওরে বাচ্চা (জাটকা) ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ে। হাকালুকির সঙ্গে মিলেছে কুশিয়ারা নদী আর কুশিয়ারা মিশেছে মেঘনায়। সে জন্য দু-চারটা ইলিশ ডিম পাড়তে স্রোত ঠেলে উজানে উঠে আসে। এদের ছানাপোনাদের মাঝেমধ্যে এখানে পাওয়া যায়। এবার আগাম ঢল হয়েছিল, তাই অন্য বছরের চেয়ে দু-চারটা বেশি মিলছে, এই আরকি!
ইলিশ মিশন সফল না হলেও হাওরের সৌন্দর্যে সবাই তখন মাতোয়ারা। যেদিকে চোখ যায়, রাশি রাশি জল। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে জেলেদের নৌকা। এরা নৌকা থেকেই পানিতে বেড় জাল ফেলছে। এখান থেকে ওখানে ছুটে চলছে মাছের সন্ধানে। জোড়ায় জোড়ায় জেলেদের নাও। কোথাও চারটি, কোথাও ছয়টি। দলে দলে চলছে মাছ ধরা। কোথাও সাদা জলের বুকে হঠাৎ সবুজে চোখ আটকে যাচ্ছে। যেন ঢেউয়ের তালে দুলে দুলে বাতাসের সুরে তাল মেলাচ্ছে। দেখা মিলবে হিজলের বাগ (বাগান)। পানির বুকে মাথা তুলে ঝাঁকড়া চুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে তারা। চোখে পড়ে হাল্লা এলাকাতেই হাওরের বুকে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও একটি ভবন। এগুলো বন বিভাগের। পর্যটকেরা যাতে পাখির চোখে হাকালুকির সৌন্দর্য দেখতে পারেন, সে জন্য এই ব্যবস্থা। পানি কমে গেলে শীতকালে অতিথি পাখি দেখতেই এই টাওয়ারের ব্যবস্থা। বর্ষাতেও নৌকায় করে টাওয়ারে পৌঁছে দেখা যায় চারপাশের জলসমুদ্র। দূরে দূরে সবুজরেখার মতো গ্রামগুলো যেন জলে ডুবে আছে।
জলে ভাসতে চলল নৌকার সন্ধান। একটি নৌকা পরিষ্কার করছিলেন দুজন। যাওয়ার জন্য সম্মত হলে ঘণ্টা খানেকের জন্য ভাড়া চাইল দেড় হাজার টাকা। এই দেড় হাজার টাকাকে কমিয়ে ৬০০ টাকায় আনতে আরও তিনজন মাঝির কাছে ধরনা দিতে হলো। দামদর করেই নৌকায় ওঠা। জলে ভেসে এবার হাকালুকিকে আরও নতুনভাবে আবিষ্কার করা। ঢেউয়ের ওপর রোদের ছোঁয়ায় ঝিলমিল করছে চারপাশ। আকাশে হঠাৎ ভাঙা ভাঙা সাদা মেঘের দেহে ছাইরঙের ছোপ।
ইলিশ-সন্ধানী দলের নৌকা তখন এখান থেকে ওখানে জেলেদের নৌকায় ছুটে চলছে। ভাসান থেকে টেনে তোলা জেলেদের জালে চিকচিক করে তাজা মাছের লাফালাফি দেখেই ইলিশের কথা ভুলে গেলাম আমরা। দিকজোড়া এই জলে ভেসে ভেসে দিনের আলো কমে আসতে শুরু করল। হলুদ সূর্যটা তখন লাল হয়ে পশ্চিমে হেলান দিচ্ছে। জলের রং পাল্টে লালচে দেখাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে জলের বুকে। কিন্তু হাকালুকি তার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মাতিয়ে রেখেছে চারদিক।

বর্ষায় হাকালুকি হাওড়। ছবি:​ লেখক
বর্ষায় হাকালুকি হাওড়। ছবি:​ লেখক