ছোট্ট গ্রামে ডেঙ্গুর বড় আক্রমণ

১৫ দিন আগেও ছাতারপাড়া গ্রামের কেউ জানত না, ডেঙ্গু রোগ কেমন? এখন সেই গ্রামের একটি পাড়ায় গত ১২ দিনে অন্তত ৩৫ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

গ্রামটি কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নে পড়েছে। পাড়াটি দাঁড়পাড়া নামে বেশি পরিচিত। জেলার মধ্যে এই দাঁড়পাড়াতেই ডেঙ্গু রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই কৃষক পরিবার। তারা কেউই দু–তিন মাসের মধ্যে ঢাকায় যায়নি।

জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) সেলিম হোসেন ফরাজী প্রথম আলোকে বলেন, দাঁড়পাড়ায় আক্রান্ত রোগীদের বেশির ভাগই সেবা নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। ১১ জন মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আলাদাভাবে জানানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগে তিনি গ্রামটির ১০–১৫ জনের আক্রান্তের বিষয়টি জানতেন। একটি গ্রামের ছোট্ট একটি পাড়ায় এত রোগীর ব্যাপারে তিনি অবগত ছিলেন না।

একই এলাকায় এত রোগীর খবর পেয়ে গত সোমবার চিকিৎসক দলসহ কর্মকর্তাদের নিয়ে দাঁড়পাড়ায় যান দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার। এ সময় রোগীদের বাড়ির আশপাশে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। চিকিৎসক দলে ছিলেন দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অরবিন্দু পাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জেলার বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রে তাঁদের রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত খেজমত আলী, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। গতকাল কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পূর্ব ছাতারপাড়া গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত খেজমত আলী, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। গতকাল কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পূর্ব ছাতারপাড়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়মিত নজরদারি করে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও তারা তা করছে। কুষ্টিয়ার ওই গ্রামের ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এমন ঘটনা তাঁদের জানা নেই।

২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হলেও তা গত বছর পর্যন্ত মূলত ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। কেবল খুলনা ও চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর সামান্য কিছু অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এবার ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবে সংক্রমণের অর্থ, দেশের বহু জায়গায় এডিস মশা আছে। আইইডিসিআরের জরিপের তথ্য বলছে, ঢাকার বাইরে প্রায় ৩৯ শতাংশ রোগী স্থানীয়ভাবেই আক্রান্ত হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার এই প্রতিবেদক কুষ্টিয়ার ছাতারপাড়ার গ্রামের দাঁড়পাড়ায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী এবং তাদের স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলেন। তাঁদের অভিযোগ, কম সময়ের মধ্যে এত রোগী আক্রান্ত হওয়ার পরও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকায় কোনো ওষুধ ছিটানো হয়নি। নিজেদের উদ্যোগে কয়েকজন তাঁদের বাড়ির আঙিনায় পোকামাকড় মারার ওষুধ ছিটিয়েছেন। তাতে মশা মরে কি না তাঁদের জানা নেই।

কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে পশ্চিমে ৩০ কিলোমিটার দূরে সড়কপথে ছাতারপাড়া গ্রামে যাওয়া হয়। এরপর সবুজ ধানখেতের মাঝে মেঠো পথ চলে গেছে দাঁড়পাড়ার দিকে। প্রায় এক কিলোমিটার পথ পার হয়ে পাড়ায় ঢোকার মুখেই পূর্ব ছাতারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাড়ার মাঝখানে কাদামাটির পথের পাশে মজাপুকুর দেখা গেল। সেখানে পাট পচানো হচ্ছে। মশার আবাসস্থলও আছে।

পাড়ার ভেতরে বাঁশবাগান ও জঙ্গলে ভরা। মাঝেমধ্যে মাটির কাঁচা ও ইটের পাকা বাড়ি। বিদ্যুৎও পৌঁছেছে। আক্রান্ত কয়েকজন রোগীর বাড়িতে টিউবওয়েলের পানি বের হবার জন্য পাশেই ছোট্ট চৌবাচ্চা করা। চৌবাচ্চার পানি কয়েক দিন ধরেই জমে থাকে। এমন স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার বংশবিস্তারের আশঙ্কা থাকে।

বিদ্যালয়ের পাশেই মাটির ঘরের বাসিন্দা কৃষক আব্বাস আলী। বাড়ির সামনে কাদামাটির সড়কের পাশে গরু লালনপালন করেন তিনি।

জানা গেল, আব্বাস আলীই এই পাড়ায় প্রথম ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ৯ আগস্ট তাঁর জ্বর হয়। ১৬ আগস্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, তিনি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। আব্বাস আলীর আশপাশের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অন্তত ৫ জনের পর্যায়ক্রমে ডেঙ্গু হয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পাড়ার বাসিন্দা বাহার আলীর ৯ বছরের ছেলে আমির হামজা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এই শিক্ষকসহ পাড়ার বাসিন্দারা জানালেন, পাড়ায় অন্তত এক শ পরিবার রয়েছে। সব মিলিয়ে এক থেকে দেড় হাজার মানুষ বাস করে। এর মধ্যে অন্তত ২০ পরিবারে ৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ২৫ জন পুরুষ।

জ্বরে আক্রান্ত আরও কয়েকজন রোগী পাওয়া গেল। তাদের ডেঙ্গু হয়েছে কি না, নিশ্চিত না। কারণ, তাদের রক্ত পরীক্ষা করানো হয়নি।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ২২ জনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের প্রায় সবাই কৃষিকাজ করেন। দু–একজন ব্যবসা করেন। কৃষক আবু সাঈদসহ তাঁর দুই ছেলে ফাহিম ও ফিরোজের ডেঙ্গু হয়েছিল। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চার দিন চিকিৎসা শেষে এখন বাড়িতে আছেন। তাঁরা কেউই ঢাকায় যাননি।

কৃষক আনিসুর রহমান নিজেসহ তাঁর ছেলে মমিনুর রহমান ও ছেলের স্ত্রী তামান্না ডেঙ্গু রোগী। আনিসুর নিজ উদ্যোগেই বাড়ির আশপাশে পোকামাকড় মারার ওষুধ ছিটিয়েছেন। প্রশাসন বা চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে এলাকায় কোনো ওষুধ ছিটানো হয়নি বলে জানান তিনি।

সাবেক ইউপি সদস্য খেজমত আলী, তাঁর স্ত্রী কহিলা ও ছেলে শামীম গত সোমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। সন্ধ্যার পর মশারির ভেতর থাকছেন। দিনের বেলায় মশারির বাইরে থাকেন।

গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বললেন, ‘তিন–চার দিন আগে এলাকায় চিয়ারম্যান আইছিল। ঝোড়-জঙ্গল কাটতিই বুইলছে। সমিস্যা হইলো পল্লি গিরাম, নোংরা হতিই পারে। কিন্তুক মশা মারার ওষুধ ছিটানো হচ্চি না।’

গ্রামের বাসিন্দা নাজিমউদ্দীন জানালেন, ঈদের সময় ১০ থেকে ১২ জন ঢাকা থেকে ঈদ করতে এলাকায় এসেছিল। তাদের মধ্যে জাহিদ নামের একজনের ঢাকায় ফিরে জ্বর হয়। পরে তিনি সরাসরি কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হলে ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়ে। তবে জাহিদের বিষয়ে নাজিমউদ্দীন আর কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

পূর্ব ছাতারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হামিদুর রহমান বলেন, মশকনিধনে এলাকায় তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। ওষুধ ছিটানো বা স্প্রে করা হচ্ছে না।

সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেল, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন ২২ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭০। বর্তমানে ভর্তি আছে ৫৮ জন রোগী।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এ এস এম মুসা কবির প্রথম আলোকে বলেন, ছাতারপাড়া গ্রাম থেকে প্রায় প্রতিদিন রোগী আসছে। তারা স্থানীয়ভাবেই আক্রান্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ওই এলাকার অন্তত ৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছে।