অন্যকে রক্তদানে উৎসাহ দিতেই সংখ্যাটা মনে রেখেছেন নজরুল

নজরুল ইসলাম এ পর্যন্ত ৪৮ বার রক্ত এবং ২৭ বার প্লাটিলেট অর্থাৎ মোট ৭৫ বার রক্ত দিয়েছেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার থেকেও বেশিবার রক্ত দিয়েছেন এমন অনেক আছেন। তবে অন্যদের উৎসাহ দিতেই ৭৫ বার রক্তদানের কথা মনে রেখেছি। এ ছাড়া কে কতবার রক্ত দিলেন, কত দিন আগে দিলেন তা নিজের এবং রোগীর ভালোর জন্যই মনে রাখা প্রয়োজন।’

রক্তকে কেন্দ্র করেই ৩৮ বছর বয়সী নজরুল ইসলামের কাজকর্ম। শুধু তাই নয়, স্ত্রী আফসানা নাজনীনের সঙ্গে পরিচয়ও ছিল এই রক্তদানকে ঘিরেই। বর্তমানে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলেই ঢাকায় অবস্থিত ডোনেট ব্লাড বিডি কলসেন্টারে এজেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। এই সেন্টারসহ রক্তদানের সব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুব্রত দেব নামে আরেক তরুণ। ২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল (পয়লা বৈশাখ) কলসেন্টারটি চালু হয়। বলা যায়, স্বেচ্ছায় রক্তদানে প্রস্তুত ব্যক্তিদের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের সেতুবন্ধনে কাজ করছেন নজরুল ইসলাম, আফসানা নাজনীন ও সুব্রত দেব।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নজরুল ইসলামের ৭৫তম রক্তদানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁর বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ১ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে নজরুল ইসলাম লিখেছেন,‘গতকাল ব্লাড দিয়ে আসছিলাম ক্যানসারে আক্রান্ত চার বছরের ফুয়াদকে। আজকে তার বাবা ফোন দিয়ে বলল, ফুয়াদ আর নাই। মনে হচ্ছিল আমার খুব আপন কেউ নাই।’ এই ফুয়াদকেই ৭৫তম বার রক্ত দেন নজরুল ইসলাম। তিনি বললেন,‘রক্ত দেওয়ার পর যারা বেঁচে যায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। তাঁর পরিবারের সদস্যদের রক্তের গ্রুপ জানার চেষ্টা করি যাতে তাঁরাও রক্তদানে উদ্বুদ্ধ হয়। এ ধরনের অনেক পরিবার আছে যে পরিবারের রক্তদানে সক্ষম সবাই রক্ত দান করেছেন।’

এ পর্যন্ত ৪৮ বার রক্ত এবং ২৭ বার প্লাটিলেট অর্থাৎ মোট ৭৫ বার রক্ত দিয়েছেন নজরুল ইসলাম। ছবি: দীপু মালাকার
এ পর্যন্ত ৪৮ বার রক্ত এবং ২৭ বার প্লাটিলেট অর্থাৎ মোট ৭৫ বার রক্ত দিয়েছেন নজরুল ইসলাম। ছবি: দীপু মালাকার

নজরুল ইসলাম আরও বললেন, একসময় বেশির ভাগ মানুষের ধারণা ছিল রক্ত কিনতে হয়। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবকেরা রক্ত সংগ্রহে এগিয়ে এসেছেন। তবে একই সঙ্গে বেড়েছে একশ্রেণির দালালের উৎপাত। এদের হাতে স্বেচ্ছাসেবকদের বিভিন্ন সময় মার খেতে হচ্ছে। কেননা স্বেচ্ছাসেবকেরা রোগীর স্বজনদের বলে দেন, কেউ যদি রক্ত দিতে টাকা চায়, তাকে যাতে বিশ্বাস না করে। অনেকে প্রতারণা করে বিকাশে যাতায়াত ভাড়া পাঠাতে বলে। ভাড়া পাঠানোর পর মুঠোফোন বন্ধ করে রাখে এই তথ্যগুলো স্বেচ্ছাসেবকেরা স্বজনদের জানিয়ে দিয়ে তাদের ব্যবসা করার সুযোগ দিচ্ছেন না।

নজরুল ইসলাম বললেন, দেশের কোনো দুর্যোগে রক্তের চাহিদা বেড়ে যায়। রানা প্লাজা ধস বা বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রক্ত চাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তবে সব চেয়ে ভালো লাগার ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে যিনি রক্ত দিতে ভয় পান তিনিও বলে রাখেন কেউ রক্ত চাইলে যাতে তাঁকে খবর দেওয়া হয়।

একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেই নজরুল ইসলামের রক্ত নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। তবে স্বেচ্ছাসেবকেরা ইচ্ছা হলে কাজ করেন, না হলে কাজ করেন না। সেভাবে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই ডোনেট ব্লাড বিডি কলসেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হন। এখন দায়বদ্ধতা অনেক বেড়েছে। এখানে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। মূলত সেন্টারের প্রধান সুব্রত দেবসহ রক্তদাতাদের ১৫ জনের একটি দল এই সেন্টার পরিচালনায় আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষার্থী। অনেকে দূরে গিয়ে রক্ত দিতে হলে এবং সামর্থ্য না থাকলে রক্ত দেওয়ার পর মাঝে মাঝে শুধু যাতায়াত ভাড়াটা দিতে বলা হয়। অথবা রক্তের সন্ধান করা স্বজনদের নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।

নজরুল ইসলাম আরও জানালেন, অনলাইনের মাধ্যমে রক্তদাতা খুঁজে দেওয়া হয়। তাই মোবাইল নেটওয়ার্ক বা ফেসবুক বন্ধ থাকলে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। বললেন,‘আমাদের মূল স্লোগান হলো- রক্তের অভাবে কেউ মারা যাবে না। আর প্রতিটি পরিবার বা একেকজনের হাতের মুঠোফোনটিই যাতে একেকটি ব্লাড সেন্টার হিসেবে গড়ে উঠতে পারে তার জন্যই আমরা কাজ করছি। এমনও হয়, ছেলে তাঁর বাবার জন্য রক্তের সন্ধান করছেন। অথচ তিনি নিজে জানেন না তাঁর রক্তের গ্রুপ। তারপর রক্তের গ্রুপ জানতে বললে কিছুক্ষণ পরে ওই ছেলে হাসিমুখে বলেন, তিনিই তাঁর বাবাকে রক্ত দিতে পারবেন।’

নজরুল ইসলাম জানালেন, সুব্রত দেব ২০১৩ সালে একটি ওয়েবসাইট (www.donatebloodbd.com) চালু করেন। স্বেচ্ছায় রক্তদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের এই ওয়েবসাইটে বিস্তারিত তথ্যসহ নাম নিবন্ধনের সুবিধা রাখা হয়। ওয়েবসাইটে গিয়ে রক্তদাতার খোঁজ না পেলে ‘রক্তদানের অপেক্ষায় বাংলাদেশ’ নামের ফেসবুক গ্রুপের সাহায্য নেওয়া যায়। রক্তদাতার সঙ্গে যোগাযোগের পর রক্তদাতারা সরাসরি চলে যান সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। পুরো কাজটিই করা হয় বিনা মূল্যে। ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে রক্তদাতা খুঁজে না পেলে আছে কলসেন্টার।

রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে রাত ১২টা এবং শনিবার দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই কলসেন্টারে ফোন দেওয়া যায়। শুক্রবার কলসেন্টার বন্ধ থাকে। কলসেন্টারের ফোন নম্বর: ০১৭৫৬৯৬৩৩০৮ অথবা ০১৭৪৮৩০৬০২৭।