চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

এই তরুণেরাই ‘পিয়ার টু পিয়ার: ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ স্প্রিং ২০১৭’ এর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব এনেছেন বাংলাদেশের জন্য। ছবি: খালেদ সরকার
এই তরুণেরাই ‘পিয়ার টু পিয়ার: ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ স্প্রিং ২০১৭’ এর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব এনেছেন বাংলাদেশের জন্য। ছবি: খালেদ সরকার

রাত তিনটায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে খবরটা এল। শারমিন আক্তার, আশরাফুল কিবরিয়া, সাব্বির আহমেদরা তখনো জেগে বসে আছেন। এডভেঞ্চার পার্টনারসের ফেসবুক পেজে তাঁরা দেখলেন, ‘পিয়ার টু পিয়ার: ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ স্প্রিং ২০১৭’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ৭০টি দেশ থেকে ১৬০টি দল অংশ নিয়েছিল এই প্রতিযোগিতায়। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল ‘থিংক টোয়াইস, অ্যাক্ট ওয়াইজ’!

সম্ভব হলে ওই মাঝরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষার্থীর (প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পাঁচজন তখন যুক্তরাষ্ট্রে) দলটা নিশ্চয়ই ছোটখাটো একটা মিছিল বের করে ফেলত! শহরবাসীর ঘুম ভাঙিয়ে চিৎকার করে বলত, ‘দেখে যাও, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি!’ আনন্দটা বাঁধভাঙার মতোই। কারণ, প্রায় এক বছর খাটুনির পর এসেছে এই পুরস্কার। সেই গল্প বলতে গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে এসেছিল ‘থিংক টোয়াইস, অ্যাক্ট ওয়াইজ’।

চরমপন্থাকে ‘না’

‘আপনারা একেকজন একেক বিভাগে পড়েন। এতগুলো মানুষ এক হলেন কী করে?’

আলাপের শুরুতে এই প্রশ্নটা করতেই হলো। উত্তর দিলেন শারমিন আক্তার, ‘আমরা বেশির ভাগই ঢাকা ইউনিভার্সিটি মডেল ইউনাইটেড নেশনস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। কেউ বন্ধু, কেউ বন্ধুর বন্ধু। এভাবেই একটা দল হয়ে গেছে।’

এবার একেবারে শুরুর ঘটনাটা জানা যাক।

গত বছরের মাঝামাঝি সময় বন্ধু ও ছোট ভাইবোনদের খবরটা দিয়েছিলেন উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র ইমরান আহসান। ফেসবুকের পৃষ্ঠপোষকতায়, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সহায়তায়, এডভেঞ্চার পার্টনারস নামে একটি সংস্থা ২০১৫ সাল থেকে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি ‘ক্যাম্পেইন’ তৈরি করতে হয়, অর্থাৎ প্রচারণা চালাতে হয়। প্রচারণার উদ্দেশ্য হলো, অনলাইনে বিদ্বেষ ছড়ানো বা চরমপন্থার (এক্সট্রিমিজম) প্রবণতাকে রোধ করা।

ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. মঞ্জুরুল আলম। ‘জঙ্গিবাদ কিংবা বর্ণবাদ, যা-ই বলেন, আজকাল ঘৃণা ছড়ানোর একটা বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক। এটা কিশোর-তরুণদের খুব সহজে প্রভাবিত করছে। তরুণেরা যেন ভুল পথে পা না বাড়ায়, ঘৃণা না ছড়ায়, সে জন্য একটা প্রচারণা চালানোই হলো এই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য।’

ঢাকার আমেরিকান কালচারাল সেন্টারের সহায়তায় গত বছর জুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষার্থীদের দলটি এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। এর মধ্যে ১ জুলাই দেশে হোলি আর্টিজান হামলার ঘটনা একটা বড় ধাক্কা দিয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন, চরমপন্থাবিরোধী এই প্রচারণা শুধু প্রতিযোগিতার জন্যই নয়, দেশের জন্যও এখন খুব প্রয়োজন। উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহানের তত্ত্বাবধানে প্রচারণার কৌশল সাজাতে শুরু করেন তাঁরা।

ফেসবুকের বৈশ্বিক নীতি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিকা বিকার্টের (বাঁ থেকে পঞ্চম) হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের দল ও তাঁদের উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান (বাঁ থেকে প্রথম)। ছবি: সংগৃহীত
ফেসবুকের বৈশ্বিক নীতি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিকা বিকার্টের (বাঁ থেকে পঞ্চম) হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের দল ও তাঁদের উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান (বাঁ থেকে প্রথম)। ছবি: সংগৃহীত

মহাযজ্ঞ

দলের নামটিই তাঁদের প্রচারণার মূল বক্তব্য। ‘থিংক টোয়াইস, অ্যাক্ট ওয়াইজ’। অর্থাৎ দ্বিতীয়বার ভাবো আর বুদ্ধিমানের পরিচয় দাও। দলটির সদস্যরা মনে করছেন, অনলাইনে হুট করে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত। সহনশীলতা, সমানুভূতি, সহমর্মিতা—এই শব্দগুলোর ওপর জোর দিয়ে তাঁরা ক্যাম্পেইনটি সাজিয়েছেন। আরও একটা বাক্যের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা। ‘অ্যাগ্রি টু ডিসঅ্যাগ্রি’। অর্থাৎ, অন্যের সঙ্গে তোমার মত না মিলতেই পারে, এটা মেনে নাও।

এই ভাবনাগুলোকে ঘিরে বেশ কিছু প্রচারণার কৌশল কাজে লাগিয়েছে ১২ জনের দলটি। ঢাকার গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলে তাঁরা কর্মশালার আয়োজন করেছেন, খুলেছেন ওয়েবসাইট (think2act.org), ব্লগ, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল। তবে এসব কিছুর আগে প্রচুর গবেষণা করতে হয়েছে। কেন তরুণেরা বিপথে যাচ্ছেন, কীভাবে তাঁদের বোঝানো যায়, কোন বিষয়গুলো নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে—এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়েছে। অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহানের পরামর্শে দলবেঁধে কাজগুলো করেছেন তাঁরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এ কে এম তওসীফ তানজীম আহমেদ বলছিলেন, ‘সব সময় দুই আর দুই মিলে যে চার হবে, তা তো নয়। এক আর তিন যোগে চার হতে পারে। চার আর শূন্য যোগ করে চার হতে পারে। এই কথাটাই

 আমরা সহজভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছি। ক্রিটিক্যাল থিংকিং কাজে লাগাও। আলোচনা করো।’

 ‘থিংক টোয়াইস, অ্যাক্ট ওয়াইজ’ দলটি প্রচারণার মাধ্যমে তরুণদের দেখাতে চেষ্টা করেছে, সামনে কত পথই না খোলা আছে! আদনান বলছিলেন, ‘বিতর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা...অনেক কিছুতে অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে, নিজের ভাবনার জায়গাটা আরও পরিণত করার সুযোগ আছে, সেগুলো আমরা ওয়েবসাইটে, ফেসবুক পেজে তুলে ধরেছি। ব্লগে তুলে ধরেছি অসাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রীতির অনেক উদাহরণ।’

 ১৬০টি দলের মধ্যে সেরা চার দলের পাঁচজন করে সদস্যকে মূল পর্বের জন্য ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আয়োজকেরা। গত ১৯ জুলাই সেখানে নাইজেরিয়া, স্পেন ও ফিলিপাইনের দলকে পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।

পুরস্কারই শেষ নয়

পিয়ার টু পিয়ার: ফেসবুক গ্লোবাল ডিজিটাল চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতাটি বিশ্বের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছেই পাঠ্যক্রমের অংশ। এই প্রতিযোগিতাটি ভিনদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কোর্স’ হিসেবে বিবেচিত হয়, ক্রেডিট যোগ হয়। মূল পর্বে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের দলটিই স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। পরীক্ষার খাতায় কোনো নম্বর যোগ হবে না জেনেও যে একটা দল এত পরিশ্রম করতে পারে, সেটাই নাকি ভিনদেশিদের অবাক করেছে।

সব শেষে তওসীফ জানালেন, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ আর পুরস্কার প্রাপ্তিটাই শেষ নয়। এই প্রচারণা তাঁরা অব্যাহত রাখতে চান। বললেন, ‘আমাদের ওয়েবসাইট, ব্লগ, ইউটিউব চ্যানেলের কাজ চলবে। কোনো স্কুল যদি আমন্ত্রণ জানায়, আমরা সেখানে গিয়েও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে “দ্বিতীয়বার ভাবার” চর্চাটা গড়ে তুলতে চাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘থিংক টোয়াইস, অ্যাক্ট ওয়াইজ’ দলের সদস্যরা

* মো. ইমরান আহসান স্নাতকোত্তর, উন্নয়ন অধ্যয়ন

* মো. সাব্বির আহমেদ স্নাতকোত্তর, উন্নয়ন অধ্যয়ন

* শারমিন আক্তার, স্নাতকোত্তর, উন্নয়ন অধ্যয়ন

* মো. মঞ্জুরুল আলম তৃতীয় বর্ষ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি

* আশরাফুল কিবরিয়া তৃতীয় বর্ষ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি

* মো. সাইফুল ইসলাম তৃতীয় বর্ষ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি

* মু. মাহ্দী হাসান সরকার তৃতীয় বর্ষ, অর্থনীতি

* সওসান সুহা তৃতীয় বর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

* এ কে এম তওসীফ তানজীম আহমেদ তৃতীয় বর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক

* আজওয়াদ আদনান তৃতীয় বর্ষ, পদার্থবিজ্ঞান

* ডি এম রহিস-উজ-জামান তৃতীয় বর্ষ, সমাজকল্যাণ বিভাগ

l জুলকারনাঈন তাসিন দ্বিতীয় বর্ষ, রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং

দলটির পরামর্শক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান