রামেন্দু-ফেরদৌসী - 'মেড ফর ইচ আদার'

শনিবার দুপুরে সেন্ট্রাল রোডের বাসায় ৫০ বছরের দম্পতি ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার। ছবি: জিনাত শারমিন
শনিবার দুপুরে সেন্ট্রাল রোডের বাসায় ৫০ বছরের দম্পতি ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার। ছবি: জিনাত শারমিন

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বন্ধুর গাড়িতে ফিরছিলেন বর-কনে। গুলশানে ভাইয়ের বাসা থেকে ফেরার পথে বন্ধ হয়ে গেল গাড়ি। চালকের আসনে বন্ধুকে রেখে নিরুপায় বর-কনে ঠেলতে শুরু করলেন গাড়ি। সেদিন ছিল ১৪ মার্চ ১৯৭০।

বিয়ের দিনের এই গল্পটা বলে একগাল হাসলেন ফেরদৌসী মজুমদার। পাশে রামেন্দু মজুমদার, হাসি উদ্ভাসিত হলো তাঁর চোখেমুখেও। গতকাল ১৪ মার্চ দাম্পত্য জীবনের ৫০ বছর পূর্ণ হলো তাঁদের। এতগুলো বছর একসঙ্গে থাকার রহস্য কী, সেটা জানতেই শনিবার ফাল্গুনের শেষ দুপুরে তাঁদের সেন্ট্রাল রোডের বাসায় যাওয়া। বসার ঘরের দেয়ালে রামেন্দু মজুমদার ও ফেরদৌসী মজুমদারের ছবি। নিচে শোপিস। পাশাপাশি দুটি মগ, তাতে লেখা ‘মেড ফর ইচ আদার’।

জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী ঘটা করে উদ্‌যাপনে স্বচ্ছন্দ নন দুজনের কেউই। দিনটি একান্তই নিজেদের। সকালে তাঁদের সঙ্গে নাশতায় যোগ দেন মেয়ে ত্রপা মজুমদার, জামাই আপন হাসান এবং নাতনি ইচ্ছা। দুপুরে প্রথম আলোর অনুরোধে খুলে বসলেন স্মৃতির কপাট। উঠে আসে ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, তখনকার সেন্ট্রাল রোড, মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, মঞ্চনাটকসহ আরও অনেক কিছু।

৫০ বছরের স্মৃতিচারণ করছেন ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: জিনাত শারমিন।
৫০ বছরের স্মৃতিচারণ করছেন ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: জিনাত শারমিন।

বিয়ের অর্ধশততম বছরের প্রথম দিন ফেরদৌসী মজুমদার পরেছিলেন ৫০ বছর আগের একটি শাড়ি। বিয়ের দিন রামেন্দু মজুমদার সেটি কিনে দিয়েছিলেন ২৫০ টাকায়। ‘আজ সকালে এই শাড়িটা পরে আমাকে চমকে দেয় ফেরদৌসী। খুব যত্নে এটা গুছিয়ে রেখেছিল,’ বলেন রামেন্দু মজুমদার। তবে তিনি কম কথার মানুষ, আলাপে মাঝেমধ্যে কেবল সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। আর ঘণ্টাখানেক স্মৃতিকথার মালা গেঁথে গেলেন ফেরদৌসী মজুমদার।
সকালে পুরোনো শাড়িটা পরতে দেখে গৃহপরিচারিকা বলেছিলেন, ‘বিয়ের গয়না পরবেন না?’ উত্তরে ফেরদৌসী বলেছিলেন, ‘গয়না পাব কই, সে সময় গয়না পরে বিয়ে করা হয়নি। অলংকারের বদলে ছিল বেলি ফুলের মালা।’

তরুণ রামেন্দু মজুমদার ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আর ফেরদৌসী বাংলার। দুজনের আলাপ হয়েছিল মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকে কাজ করতে গিয়ে। পরিচয়ের পর কেমন করে যেন বারবার দেখা হয়ে যেত দুজনের। ‘গুরুত্বপূর্ণ কাজে’ হুটহাট সেন্ট্রাল রোডে চলে যেতেন রামেন্দু মজুমদার। আবার ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরবেন ফেরদৌসী, রিকশা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব পালনে হাজির রামেন্দু। কিন্তু রিকশা আশপাশেই আছে। সেটি ডাকার কোনো তাড়া অনুভব করতেন না। এটা যে কাছে আসা, পাশে থাকার চেষ্টা, বুঝতে দেরি হয়নি ফেরদৌসীর। একদিন বাসার সামনে ঘুরঘুর করছিলেন রামেন্দু। দেখে দোতলা থেকে ফেরদৌসী মজুমদার ডেকে বলেন, ‘আপনি কি বাসায় আসবেন?’ সঙ্গে সঙ্গে কষে চড় দিয়ে বড় বোন বলেন, ‘মানুষকে এভাবে বলতে হয়? বলতে হয়, বাসায় আসেন...!’

ড্রয়িংরুমে শোপিসের লেখাটি যেন তাঁদের জন্যই। ছবি: প্রথম আলো
ড্রয়িংরুমে শোপিসের লেখাটি যেন তাঁদের জন্যই। ছবি: প্রথম আলো

বাসায় যাওয়া–আসা হলো। একদিন তাঁরা বাসা বাঁধলেন। সেটা খুব সহজ ছিল না। ফেরদৌসী বলেন, ‘আমার বাবা ছিলেন ভীষণ রক্ষণশীল মানুষ। একসময় মা-বাবা রাজি হয়ে যান আমাদের বিয়েতে। আমার দুই ভাই কবীর চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরীর সাহায্য ছাড়া বিয়েটা সম্ভব ছিল না।’ সেই বিয়েতে গয়না বলতে ছিল বেলি ফুল দিয়ে বানানো চুড়ি, কানের দুল, আর মালা। ‘কী সুন্দর ঘ্রাণ! মনটাই ভরে গিয়েছিল সেদিন,’ বলতে বলতে যেন সেই ঘ্রাণ তিনি আবারও পেলেন।

এতটা বছর একসঙ্গে পার করলেন, এ যৌথ জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া কী? ‘আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া আমাদের মেয়ে, ত্রপা। আমরা যেমন চেয়েছি, সে রকমই হয়েছে মেয়েটা। এত লক্ষ্মী হয়েছে যে কখনো দূরে যায়নি আমাদের ছেড়ে। শান্তিনিকেতনে যায়নি পড়তে। শিক্ষকতা করার সময় বড় ডিগ্রি নিতে দেশের বাইরে যেতে হবে, সেটাও করেনি। ফোনে গলার স্বর শুনলে বুঝে ফেলে আমার শরীর কেমন যাচ্ছে,’ বলেন ফেরদৌসী।

প্রতিদিনের রান্নার রেসিপি বর্ননা করছেন ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: জিনাত শারমিন।
প্রতিদিনের রান্নার রেসিপি বর্ননা করছেন ফেরদৌসী মজুমদার। ছবি: জিনাত শারমিন।

একসঙ্গে এত লম্বা জীবন অতিবাহিত করার রহস্য কী, এ প্রশ্ন রামেন্দু মজুমদারের কাছে। তিনি বলেন, ‘কোনো রহস্য নেই। পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও বন্ধুত্বের কারণেই আমরা এত দূর আসতে পেরেছি।’ রামেন্দু মজুমদারের ‘কেয়ারিং’ বিষয়টা খুব পছন্দের ফেরদৌসীর। ৫০ বছরের দাম্পত্য জীবনে টুকটাক যে রাগারাগি, ঝগড়া হয়নি—তা নয়। তবে সেটা একেবারেই কম। তবে ফেরদৌসী মজুমদার রাগলে চুপচাপ থাকেন রামেন্দু মজুমদার। সংসারের বাজার–সদাই থেকে শুরু করে সবকিছু ফেরদৌসীই সামলান। আর বাইরের, যেমন বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার হিসাব–নিকাশের সব খবর রাখেন রামেন্দু মজুমদার।

নিজে না বললেও ফেরদৌসী মজুমদার রান্নায় বেশ সিদ্ধহস্ত বলে জানা গেল। স্বামীও যে বেশ উৎসাহ দেন, সেটাও বোঝা গেল। বাংলার শিক্ষক ফেরদৌসী মজুমদার যেদিন রান্না করতে পারেন না, সেদিন একদম হিসাব–নিকাশ করে রান্নার রেসিপি লিখে যান। এভাবে লিখতে লিখতে বেশ কিছু নোটবুকের পাতা শেষ হয়েছে। সেটি এনে দেখালেন রামেন্দু মজুমদার। সেখান থেকে একের পর এক রেসিপি পড়ে শোনালেন ফেরদৌসী।

হঠাৎ ফোন আসে রামেন্দুর। জরুরি কাজে বের হতে হয়। বাড়ির বাইরে যাওয়ার মুহূর্তে ছোট্ট করে ফেরদৌসী বলেন, ‘বাইরে খেয়ো না কিন্তু...।’ আমরাও বিদায় নিই। ফেরার পথে শোপিসের লেখাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘মেড ফর ইচ আদার’।