একদিন ইরফান-সুতাপার সংসারে...

মুম্বাইয়ে আন্ধেরির ৫১ নম্বর ডিএলএইচ এনক্লেভের পাঁচতলা। পা রাখতেই নামফলক জ্বলজ্বল করে। সেখানে ইরফান, সুতাপা, বাবিল, আয়ান—এই চারটি নাম খোদাই করে লেখা। প্রয়াত বলিউড অভিনেতা ইরফান খান এখানেই থাকতেন। অনেক যত্নে, একরাশ ভালোবাসা, আর আবেগ দিয়ে ইরফান আর সুতাপা তাঁদের ভালোবাসার বাসা সাজিয়েছিলেন। আজ সেই বাসার আনাচকানাচ শুধুই বিষাদ আর নিঃসঙ্গতা। কারণ, আজ যে সেই নামফলকে ইরফানের নামের আগে জুড়ে গেছে ‘প্রয়াত’ শব্দটি।

মুম্বাইয়ে আন্ধেরির ৫১ নম্বর ডিএলএইচ এনক্লেভের পাঁচতলায় ইরফান–সুতাপার সংসার। ছবি: প্রথম আলো
মুম্বাইয়ে আন্ধেরির ৫১ নম্বর ডিএলএইচ এনক্লেভের পাঁচতলায় ইরফান–সুতাপার সংসার। ছবি: প্রথম আলো

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক পড়ন্ত দুপুরে ইরফান খানের প্রায় ৫ হাজার বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আড্ডা বসেছিল ইরফান খানের স্ত্রী সুতাপার সঙ্গে প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধির। পুরো আড্ডাজুড়ে শুধুই ছিলেন ইরফান। কারণ, সুতাপার জীবনজুড়ে যে তাঁর জীবনসঙ্গী। জানি না, আজ সুতাপা কীভাবে বাঁচবেন? ইরফানকে ঘিরে তাঁর টুকরো টুকরো অজস্র স্মৃতি আগলে কোনো রকমে বেঁচে থাকবেন তিনি। সুতপার সঙ্গে এই আলাপচারিতার এক মাস পরেই ইরফানের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে।

‘ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা’র (এনএসডি) ক্যাম্পাস থেকে ইরফান-সুতাপার একসঙ্গে পথচলা শুরু। এনএসডির প্রসঙ্গ উঠতেই স্মৃতি হাতড়ে সুতাপা বললেন, ‘সেই দিনগুলো আজ খুব মিস করি। এনএসডির ক্যাম্পাসে সবাই মিলে আড্ডা মারা, নাটক করা, সিনেমা দেখতে যাওয়া—কী সুন্দর ছিল সেই সময়গুলো! গভীর রাত পর্যন্ত সবাই মিলে আড্ডা দিতাম। রোজই মনে হতো পিকনিক করছি। সেখানকার বন্ধুত্বই ছিল অন্য রকম। মুম্বাইয়ে তো মানুষের সঙ্গে মানুষের কেবল কাজের সম্পর্ক।’

স্বামী হিসেবে দশে ছয়ের বেশি নম্বর দিতে নারাজ সুতাপা। ছবি: প্রথম আলো
স্বামী হিসেবে দশে ছয়ের বেশি নম্বর দিতে নারাজ সুতাপা। ছবি: প্রথম আলো

দীর্ঘ ১০ বছরের সম্পর্কের পর ১৯৯৫ সালে বিয়ে করেন সুতাপা-ইরফান। বললেন, ‘সত্যি বলতে কি, বিয়ের আগেও আমরা মানসিকভাবে বিবাহিত ছিলাম। নিজেদের অজান্তেই তুমি থেকে আমরা হয়েছি। ধর্ম আলাদা হলেও বিয়ে নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি। দুজনের পরিবারই এই বিয়ে মেনে নিয়েছিল।’

ব্যক্তি ইরফানের পাশাপাশি অভিনেতা ইরফানের সফরকেও খুব কাছ থেকে দেখেছেন সুতাপা। জয়পুরের সেই সাধারণ ছেলেটার তারকা হয়ে ওঠার পেছনে কখনো ভাগ্যকে পুরোপুরি কৃতিত্ব দিতে নারাজ সুতাপা, ‘ইরফান আজ এই জায়গায় নিয়ে গেছে ওর কাজের প্রতি ভালোবাসা, একাগ্রতা, সততা আর আবেগ। তাই ভাগ্যও সঙ্গ দিয়েছিল। ইরফান প্রচুর পড়াশোনা করে। প্রচুর ভাবে। তার প্রতিফলন পড়ে ওর কাজে।’

ইরফান খানের বসার ঘর। ছবি: প্রথম আলো
ইরফান খানের বসার ঘর। ছবি: প্রথম আলো

ইরফানের অভিনয়ের সবচেয়ে বড় সমালোচকও স্বয়ং সুতাপা। আর তা অকপটে স্বীকার করে বললেন, ‘আমি ইরফানের অভিনয়ের কোনো না কোনো খুঁত খুঁজে বের করি। কদিন আগে আমি ওর সঙ্গে জয়পুরে গিয়েছিলাম একটা বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে। সাধারণত আমি এ রকম যাই না। জয়পুরে আমার শ্বশুরবাড়ি বলে গিয়েছিলাম। সেই বিজ্ঞাপনের শেষ দৃশ্যে আমি ইরফানের খুঁত বের করি। শুনে ইরফান একটু দুঃখের সঙ্গে বলল, “সবই খারাপ করলাম, না কিছু ভালোও করেছি”?’ সুতাপা কোনো রাখঢাক না করে বলেন, ‘ইরফানের অনেক ছবি ভালো লেগেছে। আবার অনেক ছবি ভালো লাগেনি। তবে আমি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করি ইরফানের রুচির।’

ইরফান খান। ছবি: সংগৃহীত
ইরফান খান। ছবি: সংগৃহীত

বলিউডের সুখী দম্পতিদের মধ্যে একজন ইরফান-সুতাপা। এই সুখী দাম্পত্যের রহস্য কী? জবাবে এক হালকা হাসি হেসে সুতাপা বলেন, ‘আমরা দুজনেই ভীষণ অসামাজিক। পার্টি, হইহুল্লোড় আমরা একদম পছন্দ করি না। দুজনেই বেড়াতে ভালোবাসি। আর দুজনেই অসম্ভব প্রকৃতিপ্রেমী। জঙ্গল আমাদের সবচেয়ে পছন্দের। আমরা এতটাই প্রকৃতি ভালোবাসি যে একসময় শহর থেকে অনেক দূরে নির্জন একটা আইল্যান্ডে থাকতাম। ছয় ঘণ্টা জার্নি করে কাজের জায়গায় আসতে হতো। মাত্র দেড় বছর আগে আন্ধেরির এই ফ্ল্যাটে এসেছি। আমার বেডরুমের বারান্দা থেকে দূরের পাহাড়টা দেখা যায়। তাই এই ফ্ল্যাট আমাদের পছন্দ হয়। আমরা দুজনের কেউই পোশাকি সম্পর্কে বিশ্বাসী নই। তাই আমাদের বন্ধুর সংখ্যা খুব কম। আমাদের সবচেয়ে বড় অমিল আমাদের দুজনার সময় মেলে না। আমি যখন ঘুম থেকে উঠি, ও তখন শুতে যায়।’

ইরফান, সুতাপা, বাবিল, আয়ান—এই চারটি নাম খোদাই করে লেখা।
ইরফান, সুতাপা, বাবিল, আয়ান—এই চারটি নাম খোদাই করে লেখা।

স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে সুতাপা আরও বলেন, ‘একদম শুরুর দিকে আমরা এক কামরার ঘরে থাকতাম। নানান ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে সুন্দর করে সেই ঘরটা সাজাতাম। পায়ে হেঁটে সারা শহরটা ঘুরে বেড়াতাম আমরা। সত্যিই অন্য রকম ছিল সেই দিনগুলো।’ আন্ধেরির এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সর্বত্র জুড়ে দেশ-বিদেশের নানান শিল্পকলা ঠাঁই পেয়েছে। সুতাপা নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়ে তুলেছেন এই বাসার প্রতিটি কোণা। এত বড় বাড়ি কোনো ইন্টেরিয়রের সাহায্য ছাড়া নিজেরাই সাজিয়েছেন।

দুই ছেলে বাবিল এবং আয়ানের থেকে বেশি ইরফানকেই সামলাতে হয় বলে জানান সুতাপা, ‘আসলে ইরফান এত বেশি খুঁতখুঁতে যে সেইটা সামলাতেই হিমশিম খেতে হয়। বিশেষ করে খাওয়াদাওয়া নিয়ে। যখন যেটা মাথায় ঢুকবে তা নিয়ে পুরো বাড়িকে অস্থির করে তোলে। কিছুদিন আগে বাড়িতে টমেটো ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, এটা নাকি আমাদের দেশের সবজি নয়। এটা চীনের সবজি।’

প্রয়াত বলিউড অভিনেতা ইরফান খান এখানেই থাকতেন। ছবি: প্রথম আলো
প্রয়াত বলিউড অভিনেতা ইরফান খান এখানেই থাকতেন। ছবি: প্রথম আলো

‘খাবারদাবার নিয়ে ইরফান প্রচুর গবেষণা করে। আমাদের বাড়িতে সব অরগানিক খাবার খাওয়া হয়। কিছুদিন আগেও বাড়িতে পাউরুটি ঢুকত না। এখন একটা অরগানিক ব্রেডের দোকানের সন্ধান পেয়েছি। সেখান থেকে পাউরুটি আসে।’ চিত্রনাট্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই রকম খুঁতখুঁতে বলিউডের এই প্রভাবশালী অভিনেতা। এ ক্ষেত্রে সুতাপার মতামতকে খুবই গুরুত্ব দিতেন তিনি। স্বামীর থেকে বাবা হিসেবে ইরফানকে বেশি নম্বর দিতে চান সুতাপা। একরাশ হাসি ছড়িয়ে এই বলিউড অভিনেতার পত্নী বলেন, ‘বাবা ইরফানকে সব নম্বর দেব। তবে স্বামী হিসেবে দশে ছয়ের বেশি দেব না। সন্তানদের প্রতি ও সব রকম দায়িত্ব পালন করে। পড়ায়। কোনো ভালো তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের সঙ্গে শেয়ার করে।’

সেদিনের সেই আড্ডা ছিল যেন অন্তহীন। কখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, টের পাইনি। পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন অস্তাচলে। সুতাপার জীবনে যে এত তাড়াতাড়ি নেমে আসবে শুধুই অন্ধকার তা কে জানত!