পাখির জন্য ভালো বাসা

গ​াছে গাছে পাখির বাসা তৈরি করে দেন সৈয়দপুরের এই তরুণেরা। ছবি: প্রথম আলো
গ​াছে গাছে পাখির বাসা তৈরি করে দেন সৈয়দপুরের এই তরুণেরা। ছবি: প্রথম আলো

আগে গ্রামে গ্রামে হরহামেশাই দেখা মিলত নানা প্রজাতির পাখি। কিন্তু এখন তো তাদের আর চোখেই পড়ে না। গাছে গাছে পাখির কলরবও যেন উধাও। তাহলে কি ‘পাখি-সব করে রব, রাতি পোহাইল’ ছড়ার মতো পাখির শব্দে আর ঘুম ভাঙবে না? এমন শঙ্কা আলমগীর হোসেনকে পেয়ে বসে। তিনি ভাবতে থাকেন পাখিদের জন্য কী করা যায়। একদিন সে ভাবনা থেকেই শুরু পাখির জন্য বাসা বানানো। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরও কয়েকজন তরুণ। নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে গাছে গাছে বেঁধে দেন মাটির কলসি। তাঁদের ভালোবাসায় তৈরি হতে থাকে পাখির নিরাপদ আবাস।

নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরের এই তরুণদের উদ্যোগের শুরুটা প্রায় তিন বছর আগে। আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের ফিরিয়ে আনা। এ জন্য দরকার নিরাপদ বাসা আর মানুষকে সচেতন করা। আমরা সে কাজটিই করছি।’

তাঁর কাছেই জানা গেল, এখন পর্যন্ত সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার মাটির কলসি বেঁধেছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, পাখির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষকে সচেতন করার কাজও করছেন। এ জন্য হাজির হচ্ছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাখি বাঁচানোর সচেতনতা নিয়ে কথা বলছেন। সেই সঙ্গে সাইকেল শোভাযাত্রা, প্রচারপত্র বিতরণ চালিয়ে যাচ্ছেন।

দোয়েলের আপন আবাস
দোয়েলের আপন আবাস

পাখির জন্য নিরাপদ বাসা দিতে ‘সেতু বন্ধন’ নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন আলমগীর, রফিকুল, রিফাত, সোহাগ আল নাফিস, আকাশ, টুইংকেল, জাহাঙ্গীররা। তাঁদের মূলমন্ত্র, ‘এসো পাখির বন্ধু হই, সবুজ এ পৃথিবীকে বাঁচাই’।

সম্প্রতি সৈয়দপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গিয়েছিলাম এই উদ্যোগ দেখতে। গাছের ডালে ডালে বেঁধে দেওয়া সেতু বন্ধনের কলসিগুলোতে বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন জাতের পাখি। সৈয়দপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলায় গাছে গাছে এখন দোয়েল, শালিক, ঘুঘু, প্যাঁচা, শ্যামাসহ নানা রঙের পাখির কূজনে মুখর হতে শুরু করেছে।

কথা হয় আমানত শাহ, রফিকুল ইসলাম, কুতুব উদ্দিনসহ সৈয়দপুরের স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে। আলমগীরের কথাও শোনা গেল তাঁদের অনেকের মুখে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আলমগীর নিজের টাকায় গাছে গাছে পাখির বাসা তৈরি করছিলেন। উপজেলার খিয়ারজুম্মা থেকে খাতামধুপুর ইউনিয়নের খালিশা বেলপুকুর, ফাইলেরিয়া হাসপাতাল, প্রাণিসম্পদ হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম, কয়ানিজপাড়া, মুসলিম উচ্চবিদ্যালয়, সৈয়দপুর থানা চত্বর, খানকা শরিফ, পুরো উপজেলা চত্বর, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্কুলসহ উপজেলার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় প্রতিটি গাছে গাছে বেঁধে দেওয়া হয়েছে মাটির কলসি। কলসির ভেতরে বাসা তৈরির উপকরণও থাকে। চোখে পড়ে গাছে গাছে মুখ মোটা কলসিগুলোর সরু মুখ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি।

সেতু বন্ধনের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানালেন, তাঁরা শুধু গাছে গাছে মাটির কলসি বেঁধে দিয়েই বসে থাকেন না, কোনো অসুস্থ পাখি পেলে তারও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কোনো কলসি ভেঙে গেলে বা হেলে গেলে তা ঠিক করে দেন। ‘আমাদের এলাকায় যারা পাখি শিকার করত, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হয়েছি। আমরা তরুণেরা মিলে তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি পাখি শিকার আইনত অপরাধ।’ বলেন জাহাঙ্গীর।

শুধু সৈয়দপুরেই নয়, তাঁদের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের খানসামা উপজেলা ও নীলফামারীর সদর উপজেলার বড়ুয়া এলাকায় প্রায় ২০০ গাছে পাখির বাসার জন্য মাটির কলস বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

মাটির কল​িসই হয়ে ওঠে পাখির বাসা
মাটির কল​িসই হয়ে ওঠে পাখির বাসা

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, পাখি সংরক্ষণে গাছে গাছে বাসা তৈরির এই উদ্যোগের সুফল পেতে শুরু করেছে এলাকার মানুষ। এখন সৈয়দপুরের আকাশে প্রচুর পাখি দেখা যায়।

পাখির জন্য ভালো বাসা বানিয়ে প্রাণীর প্রতি নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করছে সৈয়দপুরের এই তরুণ দল। এ কাজের জন্য মানুষের ভালোবাসাও পাচ্ছেন এই তরুণেরা। এই ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যেতে চান ভবিষ্যতের দিনগুলোতে।