রানির আমন্ত্রণে

>
রাহাত হোসেন ও সাজিদ ইকবাল, দুই বন্ধু পেয়েছেন পুরস্কার। ছবি: খালেদ সরকার
রাহাত হোসেন ও সাজিদ ইকবাল, দুই বন্ধু পেয়েছেন পুরস্কার। ছবি: খালেদ সরকার

দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ড-২০১৭ জিতেছেন বাংলাদেশের দুই তরুণ রাহাত হোসেন ও সাজিদ ইকবাল। রানির আমন্ত্রণে আগামী বছর তাঁরা যাবেন যুক্তরাজ্যে। পড়ুন দুই তরুণের অর্জনের গল্প

রাহাত হোসেন ও সাজিদ ইকবাল দুজনই আমাদের পূর্ব পরিচিত। রাহাত হোসেনের কার্যক্রম নিয়ে এ বছরের অক্টোবরে প্রথমআলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে ‘হতাহতের পাশে ক্রিটিকালিংক’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। সাজিদ ইকবালের কথাও ছাপা হয়েছিল ২০১৩ সালে, ‘বোতলবাতির তেলেসমাতি!’ শিরোনামে। গত বুধবার জানা গেল সুখবর, দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ড-২০১৭ জিতেছেন তাঁরা। পরদিনই আমরা আমন্ত্রণ জানালাম রাহাত ও সাজিদকে, ‘চলে আসেন। বেলা তিনটায়। প্রথমআলোর কার্যালয়ে।’
দুজনকে আলাদাভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দুজনের পরনেই পাঞ্জাবি, পায়জামা, কটি দেখে খটকা লাগল। একই পোশাকের রহস্য খোলাসা করলেন সাজিদ। ‘আসার আগে আমাদের কথা হয়েছে। রাহাতই পরামর্শ দিল এমন পোশাক পরতে।’ বাহ! পুরস্কার ঘোষণা হতেই দুজন নিজেদের মধ্যে পরিচয়পর্ব সেরে ফেলেছেন? প্রশ্ন শুনে তাঁরা হাসেন। জানা গেল, দুজন শুধু পরিচিতই নন, ভালো বন্ধুও। গত বছর একটি প্রশিক্ষণে একসঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। সেই থেকে বন্ধুত্ব। তখন কে জানত, দুই বন্ধু একসঙ্গে রানির আমন্ত্রণ পাবেন!

২০১৩ সালের ২৮ জুন ‘বোতলবাতির তেলেসমাতি!’ শিরোনামে প্রথম আলোর শুক্রবারের ক্রোড়পত্র অন্য আলোতে ছাপা হওয়া প্রতিবেদন
২০১৩ সালের ২৮ জুন ‘বোতলবাতির তেলেসমাতি!’ শিরোনামে প্রথম আলোর শুক্রবারের ক্রোড়পত্র অন্য আলোতে ছাপা হওয়া প্রতিবেদন


দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ডের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা গেল, কমনওয়েলথভুক্ত দেশের ১৮-২৯ বছর বয়সী তরুণেরা এই পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে পারেন। যাচাই-বাছাইয়ের পর মানুষের জীবন মান উন্নয়নে দীর্ঘস্থায়ী ভূমিকা রাখছেন—এমন উদ্যোগী তরুণদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এ বছর বাংলাদেশের দুজনসহ কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য দেশের মোট ৬০ জন তরুণ পুরস্কার পেয়েছেন। রাজকীয় অতিথি হিসেবে আগামী বছরের জুনে তাঁরা যাবেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁদের হাতে পদক তুলে দেবেন।
বিজয়ীরা রানির হাত থেকে পদকপ্রাপ্তি ছাড়াও এই সম্মানজনক পুরস্কারের আওতায় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন কোর্স, বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের সুবিধা, যুক্তরাজ্যে এক সপ্তাহের আবাসিক কর্মশালাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। বিজয়ী তালিকার পাশাপাশি সম্মান জানাতে প্রতিযোগিতায় রানারআপদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রানারআপ হয়েছেন অমিয় প্রাপন নামের এক তরুণ।
রাহাত হোসেন ও সাজিদ ইকবাল দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রাহাত হোসেন ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। ২০১৪ সালে জেনিফার ফেরেল নামের একজন মার্কিন তরুণীর সঙ্গে শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ক্রিটিকালিংকের কাজ। দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় তাঁর প্রতিষ্ঠান। তাঁদের এই কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন প্রায় এক হাজার তরুণ। রাহাত বলেন, ‘প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ছাড়াও আমরা বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।’ তিনি বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কর্মসূচি সমন্বয়ক।
অন্যদিকে সাজিদ ইকবাল অবশ্য তাঁর পড়াশোনার বিষয়কেই কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। চেঞ্জ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন ২০১২ সালে। তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতক। পরিবেশ রক্ষায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার সাজিদের কাজের মূল লক্ষ্য। সাজিদ আবার ‘নবায়নযোগ্য’ শব্দের ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘আমরা নবায়নযোগ্য বলতে শুধু সৌরবিদ্যুৎকে বুঝি। কিন্তু আমরা চাই, স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে। যা পরিবেশসম্মত।’ তাঁর প্রতিষ্ঠান সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছিল ‘বোতলবাতি’ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে। দিনের বেলায় বস্তির অন্ধকার ঘরে সূর্যের আলো ব্যবহার করে তৈরি হতো এই বোতলবাতি। সাজিদ ইকবাল বলেন, ‘শুধু ঘরে না, এখন আমরা বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশসাশ্রয়ী বাতি পৌঁছে দিতে চেষ্টা করছি। “সোলার পাইপ লাইট”—এই প্রকল্পের কাজ চলছে।’

রাহাতকে নিয়ে এ বছর ২২ অক্টোবর প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল ছুটির দিনে পাতায়
রাহাতকে নিয়ে এ বছর ২২ অক্টোবর প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল ছুটির দিনে পাতায়


পুরস্কার জিতে এক মধুর সমস্যায়ই পড়েছেন দুই বন্ধু। বাংলাদেশ থেকে এর আগে কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন আরেক তরুণ উদ্যোক্তা ওসামা বিন নূর। পাঠক, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে, গামছা গলায় ঝুলিয়ে ওসামার রানির কাছ থেকে পদক নেওয়ার ছবিটা মনে পড়ে? ফেসবুকে ছবিটা বেশ আলোড়ন তুলেছিল। পুরস্কারের রেওয়াজ অনুযায়ী, বার্মিংহাম প্যালেসে পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে নিজ দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করে এমন পোশাক পরে যেতে হয়। কীভাবে দেশের ঐতিহ্য তুলে ধরা যায়, রাহাত আর সাজিদ এখন সেটাই ভাবছেন। দুই তরুণ বলেন, এই অর্জন তাঁদের কাজকে আরও এগিয়ে নিতে সাহস জোগাবে।