'এদের দিয়ে কিছুই হবে না'

ছবিটি প্রতীকী। প্রজন্মের ব্যবধান হলেই কটাক্ষ করা ঠিক নয়। তরুণদের বুঝতে হবে। মডেল: আফনান ও তপন আহমেদ। ছবি: অধুনা
ছবিটি প্রতীকী। প্রজন্মের ব্যবধান হলেই কটাক্ষ করা ঠিক নয়। তরুণদের বুঝতে হবে। মডেল: আফনান ও তপন আহমেদ। ছবি: অধুনা

‘আজকালকার ছেলেমেয়েদের দিয়ে কিছু হবে না, এদের না আছে দেশপ্রেম, না আছে চিন্তার গভীরতা।’ এমন কথা প্রায়ই বলতে শোনা যায় নানা আলাপচারিতায়। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের ঠিক আগের এক বা দুই প্রজন্ম এই ধরনের আক্ষেপ করে ব্যক্ত করেন নিজেদের হতাশা। নিজেদের চিন্তার জগৎকে পরিশীলিত রেখে যাঁরা দেশকে ভালোবেসে যাচ্ছেন, দেশের জন্য ভাবছেন, তাঁরা অনেক সময় বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে তাঁদের ভাবনার প্রতিফলনগুলো দেখতে পান না। কিন্তু তাই বলে কি সত্যিই বর্তমানের প্রজন্ম দেশপ্রেম বিমুখ আর ক্যারিয়ার-সর্বস্ব?

এমনটা মনে করেন না পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাষ্ট্রীয় সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের পরিচালক আবদুর রহীম খান। তিনি জানান, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মোটেই এমনটা নয়, তারাও দেশকে ভালোবাসে, নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করতে চায়, ক্যারিয়ার গঠনের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনেও সক্রিয়। তাদের ভাবনা প্রক্রিয়াগুলো খানিকটা আলাদা।

তরুণ প্রজন্মের পদ্ধতিগুলোকে ভুল বুঝে অনেক সময় হতাশ হয়ে যায় কেউ কেউ, যা পূর্বতন প্রজন্মের নৈরাশ্যবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ, তরুণ প্রজন্ম আশাবাদী, প্রতিকূল ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় অগ্রজদের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই।

আমাদের চেতনা আর চিন্তার প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রগুলোর সব জায়গায় তারুণ্যের পদচারণ। হয়তো নানা কারণে তাদের আচরণের গতিপ্রকৃতিগুলো খানিকটা অস্থির। এই অস্থিরতা তরুণ প্রজন্মের সমস্যা নয়, বরং একটি ইতিবাচক গুণ বলে মনে করেন সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের গবেষক হোসেইন মোহাম্মদ জাকি। এই তরুণ গবেষকের মতে, পরিবর্তনশীল বিশ্ব ও রাষ্ট্রের অস্থিরতা মোকাবিলা করতে হলে বর্তমান প্রজন্মকে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে পরিবর্তন করার সক্ষমতা থাকতে হবে। কোনো পূর্ব ধারণাকে (প্রি-অকুপাইড) আঁকড়ে রাখলে পিছিয়ে পড়বে বর্তমান প্রজন্ম, পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সব ইতিবাচক কার্যক্রমগুলোয় সামনের সারিতে তরুণেরাই, আমাদের সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সংগীত, সাংবাদিকতা, চিকিৎসা, ফ্যাশন এমনকি সমাজভাবনায়ও নতুন প্রজন্ম নিজস্ব জায়গা করে নিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে আবদুর রহীম খান গণজাগরণ মঞ্চের উদাহরণ দিয়ে জানান, এর রূপকার তরুণ প্রজন্ম অগ্রজদের জন্য সমাজ সচেতনতার নতুন পাঠক্রম তৈরি করতে পেরেছে।

আমাদের চারপাশে যেটুকু অপূর্ণতা রয়েছে, তার কোনো না কোনোভাবেই বর্তমান প্রজন্মকে একবিন্দু দায়ী করা যাবে না বরং অগ্রজ নীতিনির্ধারকেরাই এর জন্য সর্বাংশে দায়ী। বর্তমান প্রজন্মকে দোষারোপ না করে তাদের সঠিকভাবে বুঝে, তাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে মূল্য দিয়ে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। নেতিবাচক ও নৈরাশ্যপূর্ণ মন্তব্য ও আচরণ চলার পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্য করণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

বিরূপ মন্তব্য নয়: নতুন প্রজন্ম কী করছে আর কী করতে চায়, তা পুরোপুরি না বুঝে তাদের সম্পর্কে কোনো বিরূপ নেতিবাচক মন্তব্য করা ঠিক নয়। কটাক্ষ করা যাবে না তাদের দেশপ্রেম, চিন্তাভাবনাকে।

দিতে হবে উৎসাহ:
ভালো কাজে উৎসাহ দিতে হবে, মনে রাখতে হবে যে তাদের কাজের ধারা ভিন্ন। তাই আরেক প্রজন্মের সঙ্গে তুলনা করে নিরুৎসাহী করা যাবে না।

প্রয়োজনে অনুসরণ:
প্রয়োজনে অগ্রজরা তারুণ্যকে অনুসরণ করবেন। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় খানিকটা কমতি থাকলেও সর্বশেষ ও সাম্প্রতিক তথ্যগুলো ধারণ করে এই তরুণ প্রজন্ম, তাই তাদের ওপর আস্থা রাখা প্রয়োজন।

গঠনমূলক উপদেশ:
নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে গঠনমূলক উপদেশে পরিণত করতে পারেন অগ্রজরা। তারুণ্য যদি কখনো পথ হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থায় উপনীত হয়, তখন অগ্রজরা নতুন প্রজন্মকে পরিত্যাগ না করে তাদের সঠিক পথে নিয়ে আসতে সচেষ্ট হবেন।

থাকতে হবে সতর্ক:
তারুণ্যের শক্তিতে ভিত প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা নানাভাবে তারুণ্যের চলার পথে তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা। মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকতে তরুণ-প্রবীণ সব প্রজন্মকে সতর্ক থাকতে হবে।

সংঘবদ্ধতা:
একার শক্তির চেয়ে সম্মিলিত শক্তি অনেক বেশি কার্যকরী। তাই অপূর্ণকে পূর্ণ করতে একত্র হতে হবে। একে অন্যের সঙ্গে ভাবনাচিন্তার আদান-প্রদান করতে হবে।

পরিত্যাগ নয় পরিবর্তন:
যেসব বিষয়াদি দুর্বৃত্ত পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে, ভয় পেয়ে সেগুলো এড়িয়ে চলা যাবে না, সে বিষয়গুলোকে পরিত্যাগ করা যাবে না, বরং সেটিকে পরিবর্তন করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
বর্তমান প্রজন্মকে দিয়ে কিছু হবে না—কথাটি আদৌ সঠিক নয়, বরং চারপাশের সব দৃষ্টান্ত বলে, সমূদয় ইতিবাচক পরিবর্তন কেবল বর্তমান প্রজন্মকে দিয়েই হবে। এ জন্য প্রয়োজন সবার ভালোবাসা, সমর্থন ও উৎসাহ।
লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ