ফারাজ অবিন্তা তারিশি : কোমল হৃদয়, সুন্দর মন

তিন বন্ধু: (ডান থেকে) অবিন্তা কবীর, লেখক ও তারিশি জৈন। ছবি: সংগৃহীত
তিন বন্ধু: (ডান থেকে) অবিন্তা কবীর, লেখক ও তারিশি জৈন। ছবি: সংগৃহীত

হোলি আর্টিজান হামলার এক বছর

গত বছরের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা নৃশংসতা চালায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে। জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান দেশ–বিদেশের ২২ জন মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাণবন্ত চার তরুণ–তরুণী: ইশরাত আখন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর ও তারিশি জৈন। তাঁদের কাছের বন্ধুদের মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণা নিয়ে ছুটির দিনের প্রচ্ছদ

ফারাজ আইয়াজ হোসেন আমার কাছে সব সময় বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। আমি বিভিন্ন বিষয়ে নানাভাবে তাঁর ওপর নির্ভর করতাম। মনে আছে, আমি যখন হাইস্কুলে নতুন, তখন আমি ভলিবল খেলার চেষ্টা করি। ফারাজ তখন আমার নাম মনে করতে পারলেন, যদিও এর আগে আমাদের মধ্যে সামান্যই কথাবার্তা হয়েছিল। প্রথম প্র্যাকটিস শুরু করার আগে তিনি আমার কাছে এলেন। বললেন, ‘আমি আশা করছি একজন হাইস্কুলার হিসেবে তোমার প্রথম দিনটি ভালো কাটবে। এই সিজনে আমি তোমার কাছ থেকে বড় কিছু আশা করছি।’ ওই সিজনটা ভালোই কাটল এবং আমি খুব দ্রুত ভলিবলের বি টিমের একজন নিয়ামক খেলোয়াড় হয়ে উঠলাম। আর ফারাজ তখন সাউথ এশিয়ান ইন্টার স্কুল অ্যাসোসিয়েশন দলের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হলেন।
আমি ফারাজের কাছ থেকে ভালো অনেক কিছু শিখেছি। আমি তাঁর কাছ থেকে দৃঢ়তা, নেতৃত্ব ও যোগাযোগের শিক্ষা পেয়েছি, কিন্তু সেটা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমি চাইতাম আমার আদর্শ, আমার পথিকৃতের আরও কাছে যেতে। আমি তাঁকে আরও ভালোভাবে জানতে চাইতাম।

ফারাজের সঙ্গে লেখক
ফারাজের সঙ্গে লেখক

হাইস্কুলে প্রথম বছর পার হওয়ার পর আমরা দুজনই সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাডমিন্টন খেলব। ফারাজের কাছে এটা ছিল নতুন খেলা। আমার কাছেও তা–ই। প্রথম দিন থেকেই ফারাজ আমাকে তাঁর সঙ্গে প্র্যাকটিস করার জন্য বলতেন। আমরা তখন প্রতিদিন খেলতাম এবং দিনে দিনে দুজনে আরও ঘনিষ্ঠ হলাম। আমরা একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে ব্যবহার করতাম বা কথা বলতাম, যেন আমরা চিরচেনা, ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু। প্রতিদিন একে অপরকে ফোন করতাম, মেসেজ পাঠাতাম। আমরা তখন একসঙ্গে রাতের খাবার খেতাম এবং আড্ডা দিতাম। ব্যাডমিন্টনের ওই সিজনের মাসখানেক পর ফারাজ হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলেন। আমি তখন সত্যিই খুব কষ্ট পাই এই ভেবে যে তিনি এই স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং এখানকার হলঘরে তাঁকে আর দেখা যাবে না। কিন্তু স্কুল ছেড়ে গেলে কী হবে, পরের দুই বছর ফারাজ ঠিকই আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন নিয়মিত। তিনি স্কাইপে আমার সঙ্গে কথা বলতেন, গরম ও শীতের ছুটিতে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ফারাজ আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য, আড্ডা দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে থাকতেন। সত্যিই ফারাজ জানতেন কী করে আমাকে জাগাতে হয়। তাঁর আশপাশে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা নিজেকে সব সময় বিশেষ কিছু ভাবতেন। ফারাজের জন্যই এটা সম্ভব হতো। ফারাজ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন এবং এটা আমার জন্য বিশেষ সম্মানের যে আমি তাঁকে চিনতাম, তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি আমাকে একজন ভালো মানুষে পরিণত করেছেন এবং আজকের দিনে তিনি হাজার হাজার মানুষকে প্রভাবিত করছেন। তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সবার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। আমাদের উচিত সেই বিস্ময়কর জীবনকে উদ্যাপন করা, যেটা তাঁর ছিল।
যখন আমি চতুর্থ বা পঞ্চম গ্রেডে পড়ি, তখন আমি আমার বাবার ক্লাসরুমে গিয়ে হোমওয়ার্ক করতাম। আমি সেখানেই প্রথম দেখি অবিন্তা কবীরকে। তিনি ছিলেন আমার বাবার ছাত্রী। বাবার কাছে অঙ্ক করতে আসতেন। আমি তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে বসতাম। তখন আমি খুব লজ্জা পেতাম। কারণ অবিন্তা পড়তেন মিডল স্কুলে আর আমি মাত্র এলিমেন্টারি স্কুলে। তিনি ছিলেন লম্বা, চশমা পরা গম্ভীর এক মেয়ে। আমার বাবা মাঝেমধ্যে অবিন্তাকে বলতেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। তিনি খুশি হয়েই সব ধাপ বুঝিয়ে আমাকে অঙ্ক করে দিতেন।
এরপর অবিন্তার সঙ্গে আমার দেখা হয় হাইস্কুলে। আমি তখন সেখানে নতুন। সে সময় একবার ট্রিপে যাই। জীবনে প্রথমবারের মতো আমরা নিজেরা নিজেদের গন্তব্য ঠিক করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার জন্য সে কী উত্তেজনা আমার! অবিন্তা ও তারিশির মতো আমিও নেপালকেই বেছে নিলাম। হাইস্কুলে নতুন হিসেবে আমি প্রথম প্রথম তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঘাবড়ে যেতাম, লজ্জা পেতাম। কিন্তু আমার বন্ধুরা ছিল অবিন্তারও বন্ধু। তাদের কাছ থেকে তাঁকে আরও ভালোভাবে জানলাম।
অবিন্তা ছিলেন খুবই কোমল হৃদয়ের একজন মানুষ। অন্যদের প্রতি ভীষণ যত্নবান। গোটা ট্রিপে আমরা অনেক বিষয়ে কথা বলেছি। এর মধ্যে যেমন সিরিয়াস বিষয় ছিল, তেমনি মজার বিষয়ও ছিল। আমরা যখন কথা বলতাম, মনে হতো আমি তাঁকে বহু বছর ধরে চিনি। এ জন্য আমি আমার সব গোপন কথা তাঁকে বলতাম। একটা নিরাপত্তা অনুভব করতাম তাঁর কাছ থেকে। কোনো বিষয়ে সন্দেহ বা দ্বিধা হলে তাঁর কাছে যেতাম। তিনি এক লহমায় আমার সব দ্বিধা, সন্দেহ দূর করে দিতেন। অবিন্তা ছিলেন সেই বন্ধু, যাঁর কাছে সব সময় এমনকি দুঃসময়েও যাওয়া যেত এবং তিনি এমন একটি পথ খুঁজে বের করতেন, যা নিমেষে অন্যকে চাঙা করে ফেলত। অবিন্তার হাসিটি ছিল অমূল্য। কথা ও হাসি দিয়েই তিনি যেকোনো ঘরের পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারতেন। তিনি ছিলেন এমন একজন, যিনি মানুষের মনে দীর্ঘ ছাপ ফেলতে পারতেন। সত্যিই তাঁকে কোনো দিন ভোলা যায় না।
তারিশি জৈনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় নেপাল ভ্রমণের সময়। মনে আছে, আমি যখন প্রথম তাঁর সঙ্গে কথা বলি, মনে হয়েছিল আমি বিশ্ব জয় করেছি। আমি স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছি! বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি কখনো নেপাল ট্রিপের কথা ভুলব না। কারণ ওই ট্রিপে আমি অবিন্তা ও তারিশির ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। তারিশির সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। তাঁর যে কারও সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল। আর ছিলেন খুবই স্মার্ট। ফলে যেকোনো বিষয়ে তিনি কথা বলতে পারতেন। ওই ট্রিপের পরও আমরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। আমরা প্রতিদিনই দুজন দুজনকে মেসেজ পাঠাতাম। যখনই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতো, তিনি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতেন। তিনি ছিলেন পরোপকারী। নিজের কাজ ফেলে রেখে আমার হোমওয়ার্কে সাহায্য করতেন এবং আমার কী করা উচিত সেই পরামর্শ দিতেন। তারিশি সত্যিই একজন বিশেষ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময় মানুষের ভালো চাইতেন। যদি কখনো আপনাদের সঙ্গে তারিশির পরিচয় হতো, আপনারা তাঁকে ভুলতে পারতেন না। তিনি সব সময় আপনাদের হৃদয়ে থাকতেন। ছিলেন অসাধারণ এক মানুষ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
লেখক: শিক্ষার্থী, এলন বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক শিক্ষার্থী, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা