ইশরাত আখন্দ : আর কখনো তাঁর ফোন আসবে না

>হোলি আর্টিজান হামলার এক বছর

গত বছরের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা নৃশংসতা চালায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে। জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান দেশ–বিদেশের ২২ জন মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাণবন্ত চার তরুণ–তরুণী: ইশরাত আখন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর ও তারিশি জৈন। তাঁদের কাছের বন্ধুদের মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণা নিয়ে ছুটির দিনের প্রচ্ছদ

নিজের প্রতিষ্ঠা করা আর্ট গ্যালারিতে তরুণ চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে ইশরাত আখন্দ (মাঝে), তাঁর ডানে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
নিজের প্রতিষ্ঠা করা আর্ট গ্যালারিতে তরুণ চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে ইশরাত আখন্দ (মাঝে), তাঁর ডানে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটা গল্প থাকে। ইশরাত আখন্দের সঙ্গে আমার কি এমন কোনো গল্প আছে? মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে পড়ল না। কারণ, তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকেই তাঁকে চিনতাম। তবে মনে পড়ে তাঁকে কাছ থেকে দেখা ও জানার সুযোগ হওয়ার দিনগুলো।

শিল্পের প্রতি ইশরাতের আগ্রহ ছিল স্বভাবজাত
শিল্পের প্রতি ইশরাতের আগ্রহ ছিল স্বভাবজাত

সেটা ২০১১ সালের কথা। রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে জড়িত আছি। রোটারির সাবেক জেলা গভর্নর সাফিনা রহমান ইশরাত আপুকে আমাদের ক্লাবের মাধ্যমে নমিনেট করলেন। এই মনোনয়নটা ছিল গ্রুপ এক্সচেঞ্জ স্টাডিজ প্রোগ্রাম ২০১১-এর জন্য। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে কানাডা যাবেন ৫০ দিনের সফরে। যেখানে শুধু বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন না, শিখবেনও অনেক কিছু। তাঁর আগ্রহ অনুযায়ী কানাডার বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সংগঠন পরিদর্শন করবেন। ইশরাত সে কাজটি অত্যন্ত আনন্দ নিয়ে দক্ষতার সঙ্গেই সম্পন্ন করে ফিরে আসেন।
দেশে ফেরার পর থেকেই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। কানাডায় কী দেখলেন? এসব থেকে আইডিয়া নিয়ে আমরা কীভাবে আমাদের দেশকে আরও এগিয়ে নিতে পারি, এমন বিষয়ে আমাদের আলোচনা হতো। আমি যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি খাতের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করি, তাই অবধারিতভাবে তাঁর সঙ্গে আড্ডার প্রসঙ্গই ছিল কী করা যায় দেশের জন্য। দেশের মানুষ নিয়ে কিছু করার তাগিদ ছিল তাঁর মধ্যে।

মৃত্যুর কয়েক দিন আগে নিজের হাতে রান্না করে লেখককে এই খাবার খাইয়েছিলেন ইশরাত
মৃত্যুর কয়েক দিন আগে নিজের হাতে রান্না করে লেখককে এই খাবার খাইয়েছিলেন ইশরাত

ইশরাত আখন্দের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়, যখন তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান ক্রিয়েটিভস নামে চিত্রশালা। তিনি তাঁর সমস্ত ভালোবাসা, আনন্দ ও শ্রম দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন প্রতিষ্ঠানটিকে। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তরুণ চিত্রশিল্পীদের প্রতিষ্ঠিত করা। তাদের আঁকা ছবি সবার কাছে তুলে ধরা। বিক্রি করতে সাহায্য করা। শুধু গ্যালারি হিসেবে নয়, কীভাবে একটি সময়োপযোগী প্রশিক্ষণস্থল হিসেবে এটিকে গড়ে তোলা যায়, সেই চেষ্টা করলেন তিনি। চেষ্টা করলেন এটা যেন আনন্দ আড্ডার জায়গাও হয়ে ওঠে। আমাদের সম্পর্ক আরও নিবিড় হলো। আমার স্বল্প বুদ্ধিতে তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করতাম—কীভাবে প্রতিষ্ঠানটাকে বাণিজ্যিকভাবেও টেকসই করা যায়। অনেকেই জানেন তিনি পেশাজীবনে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁর প্যাশনের জায়গা ছিল শিল্প ও সংস্কৃতি। আমি বলব, তিনি মনেপ্রাণে একজন শিল্পী ছিলেন।
পরিচিতজনেরা জানেন, আমাদের অত্যন্ত প্রাণবন্ত ইশরাত আপু ছিলেন ডানপিটে এবং মজার মানুষ। প্রচুর আড্ডা দিতে পছন্দ করতেন। কিছুদিন পরপর ফোন করতেন: ‘আজকে বাসায় এসো’ অথবা ‘চলো ডিনারে যাই’। এটা শুধু আমার সঙ্গেই হতো, ব্যপারটা এমন নয়। তাঁর ঘনিষ্ঠ আরও অনেক বন্ধুকেই বলতেন। তারপর সবাই মিলেই যেতাম। নতুন অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হতো।
আমাকে একবার পয়লা বৈশাখের আগের রাতে ফোন করলেন। জানতে চাইলেন কী করছি? বললাম ‘বন্ধুদের সঙ্গে আল্পনা আঁকা দেখতে যাব।’ তিনিও আমাদের সঙ্গে গেলেন। অনেক মজা করে রাতে ঘুরলাম। রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত ঢাকা শহরে ঘুরেছিলাম।
একসময় তো পেশা, পরিবার ও রোটারি ক্লাব নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ইশরাত আপুর সঙ্গে আমার আড্ডা কমে যায়। তিনি আমন্ত্রণ জানাতেন কিন্তু অনেক সময় সাড়া দিতে পারতাম না।
গত বছর ১ জুলাইয়ের কয়েক দিন আগের কথা। আমি অফিস থেকে বের হয়ে কেবল গাড়িতে উঠেছি। ফোন করলেন ইশরাত আপু: ‘মাত্র বাজার করে এনেছি। ফ্রেশ মাছ কিনেছি রান্না করব, একা একা খাব না। এসো, একসঙ্গে ডিনার করি।’ কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম, ‘ওকে, আমি আসছি।’ বাসায় পৌঁছে দেখি উনি রান্নাঘরে। আমিও তাঁর সঙ্গে রান্নায় হাত লাগালাম। সেদিন আমাদের লম্বা আড্ডা হলো রান্নাঘরেই। রান্নাতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সেদিন এত দ্রুত সবকিছু কেটেকুটে রান্না করলেন, বেশ অবাকই হতে হলো।
রান্না শেষে টেবিলে সুন্দর করে সাজালেন। মোমবাতি জ্বালালেন। কী যে মজা করে খেয়েছি, আমি কখনো ভুলতে পারব না। আমি তাঁর খাবারের একটা ছবি তুললাম। রাত ১২টার দিকে তাঁর বাসা থেকে বিদায় নিলাম। সেটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। তখন বুঝতে পারিনি তাঁকে চিরবিদায় দিয়ে এসেছিলাম। কখনো দেখা হবে না। যদি প্রাকৃতিক নিয়মে ইশরাত আপু আমাদের ছেড়ে যেতেন, মনকে বোঝানো যেত। কিন্তু যা হয়েছে, তা আমাদের সবার কাছে এখনো দুঃস্বপ্ন।
ভাবলেই বুকটা হু হু করে ওঠে। ইশরাত আপুর কোনো ফোন বা টেক্সট আসবে না। ফেসবুকে আর আমাকে নক করবে না। ইশরাত আখন্দ, আপনি কোথায় আছেন? কী করেন? প্লিজ আসুন, আমরা একটু আড্ডা মারি। আসেন, প্ল্যান করি সমাজের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে কী কী করা যায়।
যেখানেই থাকুন আপনি শান্তিতে থাকুন।
লেখক: প্রিন্সিপাল বিজনেস কনসালট্যান্ট, জেন্ডার অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ক্যাটালিস্ট