তোমার স্মৃতি তোমার ছবি

শারীরিক সক্ষমতাহীন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য রবিউল গড়ে তুলেছিলেন বিদ্যালয়। সেটি এখনো চলছে
শারীরিক সক্ষমতাহীন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য রবিউল গড়ে তুলেছিলেন বিদ্যালয়। সেটি এখনো চলছে

জন্মের আগেই বাবাকে হারানো ১১ মাসের মেয়েটি বাবার ছবিতে হাত বোলায়, সাত বছরের ছেলেটি পুলিশের গাড়ি দেখলেই ছুঁয়ে দেখতে চায়—তাদের মা বারান্দার গ্রিল ধরে তাকিয়ে থাকেন পথের দিকে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তাদের একজন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল করিমের পরিবার এখন বেঁচে আছে ছবি আর স্মৃতি নিয়েই। এক বছর ধরে শূন্যতায় কাটছে তাদের দিনরাত্রি

আমার ভাতিজি কামরুন নাহার। আমরা ডাকি রায়না বলে। এক মাস পরই ওর বয়স এক বছর পূর্ণ হবে। বাবাহীন পৃথিবীতে এর মধ্যেই ১১টি মাস কাটিয়ে দিল। রায়না আমার বড় ভাই রবিউল করিমের মেয়ে।

ভাইয়ার মৃত্যুর ঠিক এক মাস পর রায়না এসেছে মায়ের কোলে। বাবার ছবিতেই যেন সব সুখ রায়নার। পুলিশের পোশাক পরা ভাইয়ার ছবিটা যেন রায়নার সকল সুখের উৎস। কোনো কারণে কান্না জুড়ে দিলে মিথ্যে গল্প বলে ওর কান্না থামাতে হয় না। বাবার ছবি দেখেই কান্না ভুলে যায় ছোট শিশুটা। ছবির ওপর হাত বুলিয়েই যেন বাবার স্পর্শ খোঁজে। মাঝেমধ্যে আপন মনে ছবিতে চুমু এঁকে দিতেও ভুল হয় না।

দুই শিশু সন্তান আর স্ত্রীর কাছে ছবি আর স্মৃতিতে আছেন রবিউল করিম। ছবি: লেখক
দুই শিশু সন্তান আর স্ত্রীর কাছে ছবি আর স্মৃতিতে আছেন রবিউল করিম। ছবি: লেখক

আমার ভাইয়া রবিউল করিম ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার ছিলেন। গত বছর ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন।

 ‘মিষ্টভাষী, নির্লোভ, পরোপকারী, ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে আমরা এক মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছি।’ এমন কথাই শুনেছি সবার কাছ থেকে। গর্বে তখন বুকটা ভরে উঠেছে আমার। সেই গর্ব নিয়েই আমরা একটি একটি করে দিন কাটাচ্ছি।

ভাইয়ার বড় ছেলে সাজিদুল করিম সামির বয়স সাত বছর হলো। বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার স্বপ্নটা অধরাই রয়ে গেল তার। এখন দাদি করিমন নেসার হাত ধরে স্কুলে যায়। একই স্কুলে পড়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার ছেলেও। পুলিশের গাড়িতে করে বাবা তাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যান। স্কুলের আঙিনায় গাড়িটি দেখলেই থমকে দাঁড়ায় সামি। গাড়িটি ছুঁয়ে দেখার বায়নাও ধরে। ভাইয়াকে হারানোর যন্ত্রণাটা তখন আরও তীব্র হয়ে ওঠে আমার মায়ের। আঁচলে চোখ মুছে সামির চাওয়া পূর্ণ করেন। পুলিশের গাড়ি নিজেও ছুঁয়ে যেন ছেলেকে অনুভব করেন।

সামির পৃথিবীটা তো বাবাকেন্দ্রিক। বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোটা অনেক বেশি অনুভব করে। গল্প করার সুযোগ পেলেই বাবার সঙ্গে দুষ্টুমি আর ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতির কথা বলে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর স্মৃতির মধ্যেই তার বসবাস।

মা আর ভাবি উম্মে সালমার কথা কী বলব—বাসার দুটি বেডরুমের সঙ্গে যুক্ত বারান্দায় প্রায়ই রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি তাঁদের। বেঁচে থাকলে এ পথেই ফিরতেন ভাইয়া।

সেদিন মায়ের সঙ্গে ইফতার করার কথা দিয়েছিলেন ভাইয়া। ভাবিকেও কথা দিয়েছিলেন দায়িত্ব পালন শেষে দ্রুতই বাসায় ফেরার। কথা রাখতে পারেননি। এ প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেয়ে তার কাছে দায়িত্ববোধ বড় ছিল।

ছোটবেলায় মা-বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘তোমরা মানুষের মতো মানুষ হও।’ এখন মাকে গর্ব করে বলতে শুনি, ‘আমার কামরুল (রবিউল করিমের ডাক নাম) মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। মা হিসেবে আমি সার্থক। আমার ছেলে দেশের জন্য, মানুষের জন্য জীবন দিয়েছে—এর চাইতে বেশি প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।’ অবশ্য এরপরই গুমরে কেঁদে ওঠেন মা। আঁচলে মুখ মুছে আবার বলতে শুরু করে দেন ভাইয়ার সঙ্গে খুনসুটির নানা গল্প।

একসময় সাংবাদিকতা করতাম। পত্রিকায় কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রায়ই ভাইয়া প্রশংসা করতেন। আবার সাবধানও করে দিতেন কোনো প্রতিবেদন পড়ে। ‘তোমরা কার বুক খালি করেছ’—এই শিরোনামের আমার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ভাইয়া অনেক প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু আজ সত্যি সত্যি আমাদের বুকটা খালি হয়ে গেছে।

ভাইয়ার সহকর্মী রবিউল ইসলাম (সিনিয়র এসি র‍্যাব-১০) ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে তাঁর ব্যবহৃত নেম প্লেটটা নিয়ে গেছেন। তিনি এই নেম প্লেট নিজের বুকের ওপর লাগাবেন। প্রতিটি অভিযানে ভাইয়ার সাহসে বলীয়ান হতে চান তিনি।

ভাইয়ার গড়ে তোলা শারীরিক সক্ষমতাহীন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটিতে (ব্লুমস) এখন ৪১ জন শিক্ষার্থী। তাঁর শূন্যতা পূরণে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির সকল স্বেচ্ছাসেবী। সহায়তা করছেন অনেক মানুষ। গত ৯ জুন শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ঈদের নতুন পোশাক।

লেখক: নিহত রবিউল করিমের ছোট ভাই