তোমার বন্ধুত্বের গল্প রয়ে যাবে চিরদিন

হোলি আর্টিজান হামলার এক বছর

গত বছরের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা নৃশংসতা চালায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে। জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান দেশ–বিদেশের ২২ জন মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাণবন্ত চার তরুণ–তরুণী: ইশরাত আখন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর ও তারিশি জৈন। তাঁদের কাছের বন্ধুদের মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণা নিয়ে ছুটির দিনের প্রচ্ছদ

ফারাজ ও চেরাব—দুই বন্ধুর দুষ্টুমি। ছবি: সংগৃহীত
ফারাজ ও চেরাব—দুই বন্ধুর দুষ্টুমি। ছবি: সংগৃহীত

ফারাজের সঙ্গে আমার প্রথম স্মৃতি কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময়কার। আমার ওই সময়ের স্মৃতি ঝাপসা, পরিষ্কার নয়। তবে আমার মনে আছে, সে কীভাবে আমাকে সমর্থন করত। ওই বয়সে ও ছিল খুবই শান্ত। বেশ অনুগত ছিল ফারাজ, যা তার বয়সের সঙ্গে তখন মিলত না। এই ব্যাপারটা বিস্ময়কর। ওর সঙ্গে খুব একটা কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। আর বছর ঘুরতে না ঘুরতে ও অন্য স্কুলে চলে গেল। ভেবেছিলাম, ফারাজের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ওটাই ইতি। আমি কি জানতাম, এই ছেলে একদিন এমন কিছু করবে, যার জন্য আমি গর্বের সঙ্গে তাকে সেরা বন্ধু বলে স্মৃতিচারণা করতে পারব?
সাত বছর পর ফারাজ যে স্কুলে পড়াশোনা করছিল, আমিও সেই স্কুলে চলে গেলাম। মনে পড়ে, প্রথম দিন আমি ওর উল্টোদিকে বসে ছিলাম। আমরা কিছুক্ষণ অদ্ভুতভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, অর্থাৎ ও রকম অবস্থায় পড়ে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। যা–ই হোক, ক্লাস শেষ হওয়ার পর ফারাজ সৌজন্য দেখিয়ে আমাকে ক্লাসের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল এবং আমাকে চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখাল। নতুন পরিবেশে সে আমাকে অনেকটাই সহজ করে দিল। এর মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে আমার যে বন্ধুত্বের সূচনা হলো, তার স্মৃতি আমি জীবনের বাকিটা সময় সযত্নে লালন করব।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি ও ফারাজ আরও ঘনিষ্ঠ হই। মনে পড়ে, বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ও ফারাজ ক্লাসের বাকিদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে নিজেরা সময় কাটিয়েছি।
সব সময়ই জানতাম, ফারাজ স্বাপ্নিক মানুষ। বিশ্বাস করুন, ওর সেরা বন্ধু হিসেবে আমি কথাটা বলছি না। স্কুলের পুরোটা সময় ফারাজ কখনোই তার অসাধারণ নেতৃত্ব গুণ দেখাতে ব্যর্থ হয়নি। ক্লাসের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ভলিবল দলের অধিনায়ক—সব ক্ষেত্রেই ফারাজ নিজেকে এমন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে আপনি তাকে বিবেচনা করবেনই। সে কত জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছে তার জন্য নয়, সে যে পর্যায়ের মানবতা দেখিয়েছে, সেটিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রশংসনীয় মনে হয়। তার পা সব সময় মাটিতেই থাকত। নিজের অবস্থান বা ক্ষমতা যেন কখনোই তার নৈতিকতা নষ্ট করতে না পারে, সে ব্যাপারে ফারাজ সচেতন ছিল। এতে বোঝা যায়, নেতাদের সব সময় কঠোর হতে হয় না, তাদের আত্মবিশ্বাস ও নম্রতা কঠোরতার কাজ করে দেয়।
ফারাজ শুধু দারুণ নেতাই নয়, সে দারুণ বন্ধুও ছিল। যেকোনো সময় সে আমার মুখে হাসি ফোটাতে পারত, আমার সব সমস্যা ভুলিয়ে দিতে পারত। এ ছাড়া স্কুল ও কেরিয়ার সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি যাতে ঠিক থাকে, সে ব্যাপারেও ফারাজ আমাকে সাহায্য করত। আমার জীবনে এখন পর্যন্ত যত অনুপ্রেরণাদায়ীর সন্ধান পেয়েছি, ফারাজ তাদের সেরাদের একজন। সে আমাকে ধৈর্যের প্রকৃত অর্থ শিখিয়েছে। সে আমাকে শিখিয়েছে, কীভাবে জবাবদিহি করতে হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, কথা দিয়ে কীভাবে তা রাখতে হয়, তাও আমি ওর কাছ থেকেই শিখেছি।
হামলার আগের রাতেই ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়। আমরা খুব অল্প সময়ের জন্যই একসঙ্গে ছিলাম। তা সত্ত্বেও আমি চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞ। কারণ, আমি ‘শেষ বিদায়’ বলতে পেরেছি।
আমার বন্ধুর জীবনে যা ঘটেছে, তাতে আমি খুবই এলোমেলো হয়ে পড়েছি। তবে সে যা করেছিল তা আমাকে মোটেও বিস্মিত করেনি। আমি জানতাম, তার নাকের ডগায় বন্ধুদের সঙ্গে এমন অন্যায় আচরণ হওয়া সত্ত্বেও সে চলে আসবে—এমন মানুষ সে নয়। ফারাজ সেটা হতে দিত না, এমনকি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও।
ফারাজ, তুমি মানবতার প্রেরণা। তরুণেরা যে আশার আলো খোঁজে, তুমি সেই আলো। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষের তুমি এখন ‘রোল মডেল’। অমরত্ব লাভের চাবিকাঠি হলো এমন এক জীবন যাপন করা, যা মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বন্ধু, তুমি ঠিক সেটাই লাভ করেছ। তোমার বন্ধুত্বের গল্প চিরকাল রয়ে যাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
লেখক: ফারাজ আইয়াজ হোসেনের বন্ধু। শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস, যুক্তরাষ্ট্র