ফারাজ: ছিল আছে থাকবে

হোলি আর্টিজান হামলার এক বছর

গত বছরের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিরা নৃশংসতা চালায় গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে। জঙ্গিদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান দেশ–বিদেশের ২২ জন মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রাণবন্ত চার তরুণ–তরুণী: ইশরাত আখন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর ও তারিশি জৈন। তাঁদের কাছের বন্ধুদের মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণা নিয়ে ছুটির দিনের প্রচ্ছদ

ফারাজের সঙ্গে লেখক (ডানে)
ফারাজের সঙ্গে লেখক (ডানে)

কোথায় যেন শুনেছি, দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আমরা দুবার পৃথিবী ছাড়ি। প্রথমবার পৃথিবী ছাড়ি কবরে চলে গিয়ে। আর দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত ছাড়াছাড়ি ঘটে যখন সর্বশেষ কেউ আমাদের নাম উল্লেখ করে, এরপর সেই নাম আর কারও মুখে ধ্বনিত হয় না। সে হিসেবে ফারাজ কোনো দিনই আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না। ওর নাম মুখে না এনে আমাদের কারও পক্ষে থাকাই সম্ভব নয়—ও যে আমাদের কত কিছু শিখিয়েছে! ফারাজ অনন্তকাল ধরে আমাদের সঙ্গে থাকবে।
আমাকে বলতে বললে বলব, ফারাজ এই দুনিয়া থেকে যতটুকু নিয়েছে, দিয়ে গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। বিনয়ী পদচারণ আর অসীম মমত্ব দিয়ে ওর উপস্থিতি ভরিয়ে দিয়ে গেছে। ওর কাজকর্মে অন্যের ওপর কী প্রভাব পড়ে—সেদিকে সারাক্ষণই খেয়াল ছিল তার।

ফারাজের সঙ্গে লেখক (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত
ফারাজের সঙ্গে লেখক (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত

ফারাজকে আমি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে চিনি। ওর কোনো তুলনা হয় না। আর সে কারণেই ওর বিবরণ দেওয়া কঠিন। বন্ধুমহলে ও ছিল দুষ্টের শিরোমণি, আবার যেকোনো কাজের বেলায় সিরিয়াস। ওর সংস্পর্শে আসা সবার প্রতিই ও ছিল সম্পূর্ণ আন্তরিক। আবার দুষ্টুমিতে ভরা ছিল বন্ধু আর পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময়।
ফারাজের যে গুণটা একেবারেই অনন্য, সেটা ওর নিরহংকার মনোভাব। সবকিছুই পেয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুকেই তার প্রাপ্য অধিকার বলে গণ্য করেনি ও। নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নিজের সাফল্য ও নিজেই গড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফারাজের অর্জন বিশ্বাসযোগ্যতা, শ্রদ্ধা আর সাফল্যকে ছাপিয়ে গেছে। অগণিত মানুষকে ফারাজ শিখিয়েছে, কীভাবে মানুষের মতো বাঁচতে হয়।
ফারাজ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বুঝি ওর শিষ্যই হয়ে গেছি। ওর মতো সাহসের অধিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখি আমি, মনে মনে চাই একদিন ওর মতোই ভালোবাসা আর মমত্বের অধিকারী হয়ে উঠতে। আমাদের অনেকেই সেটা চায়।
আবার মাঝেমধ্যে ফারাজের কথা মনে করে মনটা ভারী হয়ে আসে। যে মুগ্ধতা নিয়ে ওর সস্পর্কে কাউকে কিছু বলতাম, যে চেনা নামে ওকে ডাকতাম, সেই একই ভঙ্গিতে, একই নামে সম্বোধন করে ওর সম্পর্কে কথা বলতে চেষ্টা করি আমি। করি এ জন্য যে, আমাদের সম্পর্কটা এখনো অটুট, অপরিবর্তিত থেকে গেছে। ফারাজ ফারাজই রয়ে গেছে, আর আমি আমি। একত্রে যে ঘনিষ্ঠ জীবন আমরা যাপন করতাম, সেই পুরোনো জীবন এখনো আগের মতোই আছে—অনাহত, অবিকৃত। ওর ছোটখাটো ঠাট্টাগুলোয় আমি এখনো হেসে উঠি, একসঙ্গে মজা করার স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে পুলকিত করে। আবার দেখা হওয়ার মাঝখানের এ সময়টুকু ওর অভাব খুব বুকে বাজবে।
আমাদের মধ্যে সেরা ছিল ফারাজ। আর সে জন্যই সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা ওকে তাঁর কাছে ডেকে নিয়েছেন। আশা করি, ফারাজের কাছ থেকে কতগুলো সরল জিনিস সবাই শিখে নেবে: সব সময় সদয় মনোভাব পোষণ করে যাওয়া, মনের মধ্যে প্রবল বিশ্বাস ধারণ করা, সাহসের সঙ্গে জীবনযাপন করা, নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিজের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি করা এবং অন্তহীনভাবে ভালোবেসে যাওয়া; কেননা ভালোবাসার শক্তি অফুরান।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী