রানির সঙ্গে দেখা

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ড–২০১৭ জয়ী তরুণেরা। ছবি: সংগৃহীত
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ড–২০১৭ জয়ী তরুণেরা। ছবি: সংগৃহীত

২০ জুন যখন লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামলাম, আশা করেছিলাম কনকনে ঠান্ডা আমাদের স্বাগত জানাবে। কিন্তু কোথায় কী? আবহাওয়া তখন বেশ গরম। অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কিউওয়াইএলের (কুইন্স ইয়াং লিডার) স্বেচ্ছাসেবকেরা। আমাকে আর আমার বন্ধু সাজিদ ইকবালকে তাঁরা আমন্ত্রণ জানালেন। লন্ডনের সময় রাত ১১টা নাগাদ এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় দেশ থেকে আসা প্রায় ১০-১২ জন তরুণ মিলে রওনা দিলাম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে। রাত দুইটার দিকে যখন মেডিংলি হলে (কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল) পৌঁছালাম, মনে হলো কিসের কেমব্রিজ, ঠিক যেন হ্যারি পটারের জাদুর স্কুল হগওয়ার্টসে পা রেখেছি! এত পুরোনো ভবন, অথচ সবকিছু বেশ গোছানো।

রানির হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন রাহাত হোসেন
রানির হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন রাহাত হোসেন

দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে জরুরি প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে মার্কিন চিকিৎসক জেনিফার ফ্যারেলের সঙ্গে ‘ক্রিটিকালিংক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি আমি। ওদিকে পরিবেশবান্ধব বাতি তৈরির একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে সাজিদ। কাজের সুবাদেই গত বছর আমরা দুজন দ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হই। নানা ঝক্কিঝামেলা আর ভিসা জটিলতা পেরিয়ে লন্ডন যাত্রার উদ্দেশ্য একটাই—রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে সাক্ষাৎ!

হলে পৌঁছানোর পর জেটল্যাগ কাটাতে যে যার রুমে চলে গেলাম। এর আগেই অবশ্য কুইন্স ইয়াং লিডারস অ্যাওয়ার্ড পাওয়া অন্যান্য দেশের তরুণদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে। পরদিন সকাল থেকে শুরু হলো আসল মহাযজ্ঞ। মূল উপলক্ষটা যদিও ব্রিটিশ রানির কাছ থেকে পুরস্কার নেওয়া, তবে বেশ কিছু সভা-সেমিনারও ছিল আমাদের জন্য। নেতৃত্ব, ব্যবসার উন্নয়ন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বেশ কিছু বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা আমাদের সামনে তাঁদের মতামত তুলে ধরেছেন। এত সব সভা-সেমিনারের ফাঁকে মূল আকর্ষণ ছিল আইসিই ক্যাম্পাসের মজার সব খাবারদাবার। বিশাল বড় এক ডাইনিং হলে আমরা ৫৯ জন বিজয়ীসহ প্রায় ৮০ জন তিন বেলা একসঙ্গে খেয়েছি। এই সময়টাতেই সবার বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়েছে।

প্রতিদিনই রাত আটটার আগে সেশনগুলো শেষ হতো। তারপর দলে দলে ভাগ হয়ে সবাই বেরিয়ে পড়তাম শহর দেখতে। একদিন তো পাশের বাগানে বড় প্রজেক্টর লাগিয়ে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতাও হলো। ইনডোর গেমস খেলার সুযোগ ছিল। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাসটাও ঘুরে দেখলাম একদিন। ব্রিটিশদের ঐতিহ্যবাহী নৈশভোজ আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমাদের কেমব্রিজ পর্ব।

২৪ জুন সবাই মিলে চলে আসি লন্ডনের মূল শহরে। এখানেও বেশ কিছু কার্যক্রমে অংশ নিলাম আমরা। বিবিসির অফিস থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের গ্লোবাল অফিস, ফেসবুক এবং গুগলের অফিস ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। যেদিন বিবিসির অফিসে গেলাম, হুট করে জানানো হলো, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে এবং টেস নামের আরেক বিজয়ীকে বিবিসির একটা লাইভ অনুষ্ঠানে কথা বলতে হবে। শুনে খুশি হলেও একটু একটু ভয়ও করছিল। যে ছয় মিনিটের জন্য লাইভে ছিলাম, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর বাইরে অন্য একটা জগতে চলে এসেছি, যেখানে হাজার হাজার চোখ আমাকে দেখছে!

এর মধ্যে ব্রিটিশ তারকা ফুটবলার ডেভিড বেকহামের সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল সাজিদের। প্রায় ৪৫ মিনিট ওদের দলটার সঙ্গে ছিলেন বেকহাম। এত দূর এসে আমি তাঁর সাক্ষাৎ পেলাম না বলে আফসোস একটু হচ্ছিল বৈকি। ফেসবুকে বেকহামের সঙ্গে সেলফি আপলোড করে সাজিদ আক্ষেপটা আরও বাড়িয়ে দিল। যা হোক, পরদিন ছিল ঈদ। লন্ডনের অন্য মুসলিমদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়লাম। ভিনদেশে প্রথম ঈদ করার অভিজ্ঞতাও যোগ হলো আমাদের ঝুলিতে।

রানির হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন সাজিদ ইকবাল
রানির হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন সাজিদ ইকবাল

কাঙ্ক্ষিত দিনটি এল ২৯ জুন, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণের পালা। আগেই বলা হয়েছিল, দেশের ঐতিহ্য বহন করে এমন পোশাক পরে যেতে হবে। আমি পরলাম সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা, কটি আর শাল। শালের ওপর লেখা ছিল বাংলা বর্ণমালা। সাজিদ পরেছিল পাঞ্জাবি, পায়জামা, সঙ্গে গামছা প্রিন্টের কটি। বাকিংহাম প্যালেসে যাওয়ার জন্য যখন সবাই বাসে উঠলাম, দৃশ্যটা ছিল দেখার মতো। সবাই যার যার দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে প্রস্তুত, এখানে একেকটা মানুষই একেকটা দেশ।

পা রাখলাম বাকিংহাম প্যালেসে। লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন যে প্রাসাদটা বাইরে থেকে একনজর দেখার জন্য ছুটে আসে, আমাদের কিনা সেই প্রাসাদের ভেতরে ঢোকারও সৌভাগ্য হলো! প্রথমেই আমাদের মহড়া করানো হলো। কীভাবে পুরস্কার নিতে হবে, কীভাবে কী করতে হবে ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর রানি এসে উপস্থিত হলেন।

যখন আমার নাম ডাকা হলো, মনে হলো চারদিকে সবকিছু স্থির হয়ে গেছে। অনেকটা জোর করে সামনে পা বাড়িয়ে এগোলাম। রানির হাত থেকে পুরস্কার নিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আমি কী করি। সব মিলিয়ে ৩০ সেকেন্ডের মতো কথা বলেছি। রানির সঙ্গে হাত মিলিয়েছি।

তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল পরদিন ৩০ জুন, যখন খবর পেলাম আমিসহ অন্য দুটি দেশের বিজয়ীকে রানি ব্যক্তিগত মিটিংয়ের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। ভাবতেও পারিনি আবারও রানির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হবে এবং পাক্কা ২৫ মিনিট ধরে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন! বললেন, ১৯৮৩ সালে তিনি একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই ভ্রমণের স্মৃতি থেকে বললেন, ‘তোমাদের গ্রামগুলো অনেক সুন্দর।’ আমাদের দেশের খবরাখবরও নিলেন।

এরপর ফেরার পালা। সবার মন খারাপ। ১০ দিন ধরে সবাই একসঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি। সত্যিই স্বপ্নের মতো ছিল দিনগুলো।