ইজিবাইক, মেয়েরা সাবধান!

নির্মাণ ত্রুটির কারণে ইজিবাইকে মেয়েদের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চলাচল করতে হবে সাবধানতার সঙ্গে। ছবিটি ঢাকার আশকোনা এলাকা থেকে তুলেছেন খালেদ সরকার
নির্মাণ ত্রুটির কারণে ইজিবাইকে মেয়েদের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চলাচল করতে হবে সাবধানতার সঙ্গে। ছবিটি ঢাকার আশকোনা এলাকা থেকে তুলেছেন খালেদ সরকার

অন্যদিনের মতোই সিরাজগঞ্জ শহরে ইজিবাইকে চড়েছিলেন তিনি। তাঁর ওড়না চলন্ত ইজিবাইকের মোটরে আটকে গেল। ঘাড়ের হাড় ভেঙে যায় লিপির। সেদিনের পর লিপির পুরো শরীর অবশ হয়ে গেল। সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুর্নবাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। শরীর অবশ, কিন্তু সন্তান জন্মানোর সময় এগিয়ে আসছে। অবশ শরীরে সন্তান জন্মদানের চিকিৎসা সিআরপিতে না থাকায় তাঁকে অস্ত্রোপচারের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলো। জন্ম নিল লিপির সন্তান। নিজের চলাফেরা করার ক্ষমতা নেই, তাই সন্তানের দায়িত্ব নিতে চান না। এমনকি মায়ায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে সন্তানের মুখ পর্যন্ত দেখতে চাননি। সিআরপি কর্তৃপক্ষ লিপির সন্তানকে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ ঘটনা শুনি ২৯ জুলাই ঢাকার সাভার উপজেলার সিআরপিতে গিয়ে।

লিপি তো একজন। আরও ঘটনা জানা যায়। গাইবান্ধার ১৫ বছরের শাম্মীরও এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। চাচাতো বোনের সঙ্গে কেনাকাটা করতে যাচ্ছিল ইজিবাইকে করে। হঠাৎ ওড়না আটকে যায়। মুহূর্তেই মেরুদণ্ডে আঘাত পায়। অজ্ঞান হয়ে যায়। এরপর গাইবান্ধায় কিছুদিন চিকিৎসা চলে। ৩০ জুলাই মুঠোফোনে শাম্মী প্রথম আলোকে বলে, ‘গাইবান্ধায় যখন আমার শারীরিক কোনো উন্নতি হচ্ছিল না, তখন আমাকে সিআরপির কথা বলেন চিকিৎসকেরা। সেখানে নানা রকম থেরাপি চলে। কথা বলতে পারি আবার। হাতে শক্তি ফিরে আসে। তবে শরীরের নিচের অংশ এখনো অবশ।’ আশার কথা হলো, শাম্মী আবার স্কুলে যেতে শুরু করেছে। লেখাপড়া করছে।

গত ঈদুল ফিতরের সময় ইজিবাইকে ওড়না পেঁচিয়ে মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত তিনজন ভর্তি হয়েছিলেন সিআরপিতে। তাঁদের মধ্যে দুজন মারা যান।

সিআরপির তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে এই ইজিবাইকে ওড়না পেঁচিয়ে ৩৬ জন নারী ও ১ জন পুরুষ মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে শারীরিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় সবচেয়ে বেশি এমন দুর্ঘটনার হার। ঢাকা বিভাগে ১৫ জন এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হন। খুলনায় ৭ জন, রংপুরে ৬ জন, চট্টগ্রামে ৪ জন, বরিশালে ৩ জন এবং রাজশাহীতে ২ জন এই ভয়াবহতার মুখোমুখি হন। কেউ কেউ প্রাণ হারান।

দুর্ঘটনায় পড়া বেশির ভাগ নারীর বয়স ২০ বছরের নিচে। পরিসংখ্যান বলে, দুর্ঘটনার শিকার ২৩ জন নারীর বয়স ২০-এর নিচে আর ১৩ জনের বয়স ২০-এর ওপরে।

সিআরপির নির্বাহী পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের ইজিবাইক যেহেতু গ্রামীণ এলাকায় চলে, তাই সব দুর্ঘটনার খবর হয়তো আমাদের কাছে আসে না। দুর্ঘটনার পরপর স্থানীয় হাসপাতালে বা ক্লিনিকে চিকিৎসা করান কেউ কেউ, সে সময়ও অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। এটা এমন কোনো সমস্যা নয়, যা সমাধান করা যাবে না। সিআরপি ইতিমধ্যে অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। ইজিবাইকের নির্মাণগত ত্রুটির কারণে এমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। ইজিবাইকের ভেতরে থাকা ফাঁকা জায়গা দিয়ে ওড়না নিচের মোটরে আটকে গিয়ে দুর্ঘটনা  ঘটে। সিআরপি ৫০০ ইজিবাইকে কাঠ দিয়ে এই ফাঁকা জায়গা বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছে। সবাই মিলে সচেতন হলে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।’

 কীভাবে ঘটে দুর্ঘটনা?

ইজিবাইকের চালকের আসন ও যাত্রীদের বসার আসনের মাঝে ফাঁকা থাকে প্রায় ছয় ইঞ্চি। এর মধ্য দিয়ে ওড়না, শাল, চাদর ঝুলে গিয়ে মোটরে আটকে যায়। শুধু ইজিবাইক নয়, রিকশা, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও মোটরযানের সঙ্গেও ওড়না পেঁচিয়ে যেতে পারে।

 দুর্ঘটনার ভয়াবহতা

সিআরপির মেডিকেল সার্ভিস উইংসের রেজিস্ট্রার ইশরাত জাহান জানালেন এর ভয়াবহতা। মোটরযান দ্রুতগতিতে চলে। তাই মুহূর্তে ঘটে এই দুর্ঘটনা। ঘাড়ে থাকা মেরুদণ্ডের পাঁচ ও ছয় নম্বর হাড় সরে যায়। মেরুরজ্জু আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এতে শরীর বোধশক্তি ও কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ঘাড়ের আঘাতের কারণে কারও কারও শ্বাসকষ্ট হয়। এ থেকেও অনেকে মারা যায়।

ইশরাত জাহান বলেন, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ামাত্র সময় নষ্ট না করে সিআরপি বা পঙ্গু হাসপাতালে নিতে হবে। সাধারণ হাসপাতালে এই রোগীদের সঠিক চিকিৎসা হয় না। পরে রোগীকে আরও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

আঘাত পাওয়ার পর খেয়াল রাখতে হবে, ঘাড়ে যেন আর আঘাত না পায়। যত কম নড়াচড়া করানো যায়। ঘাড়ের নিচে, পিঠের নিচে ও পায়ের নিচে হাত রেখে স্ট্রেচারে শুইয়ে হাসপাতালে নিতে হবে।

 প্রতিরোধের উপায়

সফিকুল ইসলাম মনে করেন, সব ক্ষেত্রের মানুষের চেষ্টা ও সচেতনতা পারবে এটি দূর করতে। খোলা যানবাহনে চলাচলের সময় ওড়না পেছনে ঝুলিয়ে না রেখে সামনে কোলের ওপর নিয়ে বসতে হবে। চেষ্টা করবেন ওড়না পরা অবস্থায় অটোরিকশাচালকের পাশে এবং চালকের পেছনের আসনে না বসতে। কারও খেয়াল  না থাকলে তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া।

সমস্যা এখানে শেষ হচ্ছে না। সাধারণত এ ধরনের ইজিবাইক চীন থেকে আমদানি করা হয়। ঢাকার টঙ্গী ও মুগদাপাড়ায় এর যন্ত্রাংশ সংযোজন করে ইজিবাইক তৈরি করা হয়। যেহেতু চীনের মেয়েদের ওড়না পরার অভ্যাস নেই, তাই সেখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হওয়ায় এমন ভয়াবহতার শিকার হচ্ছেন নারীরা।

সাভার পৌরসভা অটোবাইক মালিক সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দীন ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সমিতির অধীনে ১০০ ইজিবাইক আছে। সেগুলোতে টিনের পাত ও কাঠ লাগানো হয়েছে। সিআরপির সঙ্গে মিলে সাভার এলাকার বেশির ভাগ ইজিবাইকে কাঠের পাটাতন লাগিয়েছি আমরা। আশপাশের ইজিবাইক বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে জানানো হয়েছে দুর্ঘটনার কথা। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন,   প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবেন। তবে পুরোনো ইজিবাইকে এই সমস্যা আছে। নতুন আসা ইজিবাইকগুলোতে এই ফাঁকা  জায়গা থাকছে না। তারপরও  আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য   কাজ করব।’

ইজিবাইক অবৈধ। এটি নিরাপদ নয়, তাই সড়কে চলাচলের জন্য বিআরটিএর অনুমোদনও নেই। তারপরও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ঢাকার বাইরে ইজিবাইক চলাচল করছে। এ প্রসঙ্গে ইজিবাইক নিয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই রাব্বানী বলেন, ‘ঢাকায় বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মনিটরিং করে তাই ঢাকায় এটি চলাচল করে না। ঢাকার বাইরে যেখানে মনিটরিং করা যায় না, সেখানে ইজিবাইক বেশি চলে। পুলিশ বাহিনীও এ ব্যাপারে কাজ করছে। আমরাও আরও পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছি।’

এক মুহূর্তে জীবন বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে কর্মক্ষমতা। নিজে সচেতন হোন, অন্যকেও করুন। শাম্মীর মা বলেছিলেন, কারও মা-মেয়ে, বোনের যেন এমন না হয়। পরিবারে যেন নেমে না আসে অন্ধকার।