তাঁদের সম্মান জানানোর যোগ্যতাটাও আমাদের নেই

এ আর চৌধুরী
এ আর চৌধুরী

দুজনেরই জীবন ছিল কঠোর নিয়মের। নিজেরা নিয়ম মানতেন অক্ষরে অক্ষরে। মানতে গিয়ে, মানাতে গিয়ে তাঁদের বিড়ম্বনার শেষ ছিল না। নিজেরা ছিলেন রহস্যঘেরা অথবা রহস্য করতে তাঁরা পছন্দ করতেন। আলাপে-আচরণে অন্যদের বিমোহিত করার শক্তি ছিল তাঁদের। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং তাঁর সহকারী লে. কর্নেল এ আর চৌধুরীর কথা বলছি। তাঁদের নিয়ে এখন আর তেমন আলোচনা হয় না। জেনারেল ওসমানী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের সমরনায়ক। অপরজন লে. কর্নেল এ আর চৌধুরী ছিলেন তাঁর সহকারী।

সত্তরের নির্বাচনে এম এ জি ওসমানী আমাদের নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচন করেছিলেন। তাঁকে দেখা, তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প তখন থেকেই শুরু। পরবর্তীকালে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর সান্নিধ্যে আসারও সুযোগ হয়েছিল। সৌভাগ্য হয়েছিল কাছে বসে তাঁর অনেক গল্প শোনার। এম এ জি ওসমানীকে নিয়ে লেখার বা আলোচনার জন্য এ লেখা নয়। এ লেখা তাঁর এক সামরিক সহযোগী লে. কর্নেল এ আর চৌধুরীকে নিয়ে।

জেনারেল এম এ জি ওসমানী ঘরে বসে আয়েশে গল্প করতেন। মুক্তিযুদ্ধের টুকরো টুকরো গল্প তাঁর কাছ থেকে শোনা যেত। এসব গল্পে তাঁর সামরিক সহযোগীদের নিয়ে নানা প্রশংসা থাকত। কারও কারও বিষয়ে তাঁর বিরক্তিও প্রকাশ করতেন চরমভাবে। দরজা বন্ধ করে নিজের টাইপরাইটারে নিয়ম করে লিখতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনা নিয়ে বিতর্ক, কার কী ভূমিকা—এসব নিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসার প্রশ্নে মেজাজি এ জেনারেল বিরক্ত হতেন না, তবে এড়িয়ে যেতেন। চাপাচাপি করলে ইঙ্গিত দিতেন, তিনি লিখছেন। তাঁর লেখায় অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে। এম এ জি ওসমানীর মৃত্যুর পর তাঁর লেখা পাণ্ডুলিপির কী হলো কেউ জানেন না। জানা যায়নি, এ পাণ্ডুলিপি তিনি কাউকে দিয়ে গেছেন কি না? নাকি কেউ পাণ্ডুলিপিটি গায়েব করে দিয়েছে অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে? অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই। জানার সুযোগও নেই এখন আর।

আলাপের মাঝখানে একদিন জেনারেল ওসমানী বললেন, ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু সি এ সেন্ট, গো টু “গ্রিন হিল” অ্যান্ড মিট এ আর চৌধুরী।’ আমার জানা ছিল, আমাদের শহরতলির খাদিমনগর এলাকায় গ্রিন হিল নামের এক বাড়িতে এ আর চৌধুরী নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বাস করেন। অনেকটা উৎসাহ নিয়েই তাঁকে দেখতে যাওয়া। ১৯৮১ সালের কোনো এক বিকেলে সাইকেল চালিয়ে তাঁকে দেখতে যাই নেহাত ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে। যাওয়ার আগে আমার কাছে তথ্য ছিল লে. কর্নেল এ আর চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম কর্ণধার। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সরাসরি যোগদান দেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠনের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর স্টাফ অফিসার হিসেবে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিযুক্ত ছিলেন। একপর্যায়ে সহপ্রধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গ্রিন হিলে গিয়ে দেখি, একজন খর্বাকৃতির লোক আনমনে সবজি চাষে ব্যস্ত। আমার ইচ্ছের কথা জানালাম, এ আর চৌধুরী সাহেবের ‍সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। বসতে বললেন। কিছুক্ষণ পর পাশে বসেই জানতে চাইলেন আমার পরিচয়, কেন এসেছি? ততক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি জেনারেল ওসমানীর ‘সেন্ট’ আমার সামনে। নিত্য পরিপাটি থাকা আর হুকুম দিয়ে চলা জেনারেলের চেয়ে উনি যে এক ভিন্ন মানুষ, তা জানিয়ে দিলেন প্রথম আলাপচারিতায়। চা-বিস্কুট দিলেন। নিজেও খেলেন। এখানে আবার পার্থক্য দেখলাম, জেনারেল ওসমানী আপ্যায়ন করতেন ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু কখনো আমাদের সঙ্গে খেতে বসতেন না। একধরনের সামরিক আভিজাত্য বজায় রেখে চলতেন। এ আর চৌধুরী তা করলেন না।

আমি যে জেনারেল ওসমানীর কাছ থেকে শুনে দেখতে গেছি, তা জানালাম। কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। নানা প্রশ্নে আমাকে ঝালাই করার চেষ্টা করছিলেন। দীর্ঘ বিকেলের কথামালায় আমি চেষ্টা করলাম আলাপচারিতাকে মুজিবনগর সরকারের দিকে নিয়ে যাওয়ার। ওখানকার অনেক গল্প, বিশেষ করে মুক্তিবাহিনী গঠন এবং সামরিক যুদ্ধের কৌশল নিয়ে নানা বিরোধের প্রশ্ন খোঁজাই ছিল আমার আলাপচারিতার উদ্দেশ্য। টের পেলাম, এ এক কঠিন কাজ। কোনো কারণে হোক মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাঁর আলাপচারিতা নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছি। এরপর আমি কয়েক দফা গেছি। কথা বলেছি। কখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো আলাপের গভীরে তিনি যেতে চাননি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথা আমিই উঠিয়েছি। তাঁর কাছ থেকে কোনো কথাই জানা সম্ভব হয়নি। অনেকটা অনুযোগ করে একদিন বলেছিলাম, ওসমানী স্যার লিখছেন, আপনি কি লিখবেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা। না লিখলে আমরা জানব কী করে?

জেনারেল ওসমানীর মতো তিনিও ঘন ঘন ইংরেজি বলতেন। হুবহু মনে না থাকলেও যা বলেছিলেন, তার মানে মনে আছে। বলেছিলেন, রাষ্ট্রের অনেক গোপন বিষয় গোপন থাকাই ভালো। এ নিয়ে জেনারেল ওসমানীর কাছে যখন অনুযোগ করলাম, স্যার এ আর চৌধুরীর কাছে গল্প শুনতে যাই। তিনি তো কিছু বলেন না। রহস্যময় হাসি হেসে ওসমানী জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়ে কী বলেন এ আর চৌধুরী। আমি বলি, তিনি গোপন কথা বলতে চান না। ওসমানী বিড়বিড় করে বলেন, নেশন ইজ নট রেডি টু হিয়ার অল অ্যাবাউট দৌজ।

দুই সেনানায়কের এসব রহস্যময়তার আজও কোনো কূলকিনারা পাই না। তাঁদের কাছে কী এমন ছিল, যা জানাতে তাঁরা কুণ্ঠিত ছিলেন?

১৯৮২ সালে তখনকার দৈনিক বাংলার চিঠিপত্র কলামে ‘সিলেটে তুলা চাষের সম্ভাবনা’ নিয়ে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছে। সিলেটে তখন টেক্সটাইল মিল হচ্ছে। তুলা চাষ স্থানীয়ভাবে করা গেলে ভালো হয়—এমন কোনো লেখা। হঠাৎ করে পেপার কাটিং নিয়ে বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ডের দুই কর্মকর্তা উপস্থিত সিলেটে। আমাকে খুঁজে পেয়েছেন। কাগজ দেখিয়ে জানালেন, তাঁরা গ্রিন হিলে এ আর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে চান। কারণ হিসেবে জানালেন, তাঁদের কাছে খবর আছে, এ আর চৌধুরী পাকিস্তানের তুলা চাষের এলাকায় দীর্ঘদিন চাকরিতে ছিলেন। তুলা চাষ নিয়েও তাঁর নাকি ব্যাপক জ্ঞান। কর্মকর্তাদের নিয়ে আমি তাঁর কাছে যাই। আবার আন্তরিক আপ্যায়ন। এর মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা।

আমার লেখার সূত্র ধরে সিলেটে তুলা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলি। এ আর চৌধুরী খুশি না হয়ে বলেন, কোনো পূর্বধারণা ছাড়াই আমি লিখেছি। সিলেটে তুলা চাষের কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানকার আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত তুলা চাষের জন্য কোনোভাবেই অনুকূল নয়। এ কারণে রাষ্ট্রের দুজন কর্মকর্তা সরকারি খরচে ঢাকা থেকে সিলেট এসেছেন। অনেক ব্যয় হয়ে গেছে—এ নিয়ে গজ গজ করলেন। এই প্রথমবারের মতো দেখলাম, আমার ওপর বেশ বিরক্ত। না জেনে, না বুঝে লেখার কারণে এমনটি হয়েছে বলে আমাকে দায়ী করলেন। চুপসে যাওয়া মন নিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা খুবই বিব্রত। কারও সঙ্গে কারও কথা নেই। গ্রিন হিলের বাড়ি থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাটি থামলেন। আমাকে প্রবোধ দিতে গিয়ে পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, এ আর চৌধুরীদের মতো দেশপ্রেমিকদের সম্মান জানানোর যোগ্যতাটাও আমাদের নেই।

২০০০ সালের ৭ ডিসেম্বর নিজ বাড়ি গ্রিন হিলে মৃত্যুবরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সমরনায়ক নিভৃতচারী দেশপ্রেমিক লে. কর্নেল এ আর চৌধুরী।