নীরবতা ভেঙে টাইমের প্রচ্ছদে

মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানোর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে
মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানোর যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে

সুদূর মার্কিন মুলুকের সংগীতশিল্পী লেডি গাগা। অকপটে জানালেন যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার বাজে অভিজ্ঞতা। চাপা দিয়ে রাখা একই কষ্টের কথা সবাইকে বলে দেন মিসরের মেয়ে শায়মা খালিল। বহুদূরের বাংলাদেশে বসে অনেক নারী নীরবতা ভেঙে জানালেন, তাঁরাও এই দলে। মানচিত্র আর দূরত্ব ছাপিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তের নারীদের একসূত্রে গেঁথেছে একটি আন্দোলন, #MeToo (হ্যাশট্যাগ মি টু), মানে আমিও। 

এই আন্দোলন কী যে এক জাদুর কাঠি ছুঁয়ে দিল! হাজার হাজার নারী তাদের মনের বাক্স খুলে দিল। বাক্সটায় গভীর যন্ত্রণায় বন্দী করে রাখা ছিল যৌন নিপীড়নের ভয়াবহ কষ্টগুলো। বাক্স থেকে বের হয়ে দুঃসহ স্মৃতিগুলো ভরিয়ে দিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার, ফেসবুকের পাতা। লজ্জা-সংশয় ভেঙে নারীরা বলল তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কথা। কিছু পুরুষ জানাল, বাদ যায়নি তারাও। মুখোশে ঢাকা কুৎসিত মুখগুলো সবাইকে চিনিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানাল কেউ কেউ।

টাইম মাগ্যাজিনের প্রচ্ছদ
টাইম মাগ্যাজিনের প্রচ্ছদ

সাম্প্রতিক সময়ে আর কোনো ঘটনা এতটা নাড়া দেয়নি। লজ্জা-দ্বিধার সংস্কৃতি ভেঙে সরব করেনি। গভীর কষ্টে ছুঁয়ে গিয়ে প্রতিবাদী হতে শেখায়নি। বলেনি লজ্জাটা নিপীড়িতের নয়, নিপীড়কের। তাই এই আন্দোলনকে দেখা হচ্ছে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী পরিবর্তন হিসেবে। নীরবতা ভেঙে বেরিয়ে আসার এই সাহসকে সম্মান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী টাইম। তারা হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনে শামিল হওয়া নাম জানা-অজানা সাহসীদের ‘পারসন অব দ্য ইয়ার’ (বর্ষসেরা ব্যক্তি) ঘোষণা করেছে।
এ বছর সাড়া ফেললেও আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ২০০৭ সালে। তারানা বুর্কে নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ নারী যৌন নির্যাতনবিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তখন তেমন সাড়া মেলেনি। ১০ বছর পর আবার মাঠে আসে যৌন নিপীড়ন ও হয়রানিবিরোধী প্রচারণা হ্যাশট্যাগ মি টু। এবার এর শুরুটা করেন মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। হলিউডের মুভি মোগল হার্ভে উইনস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির খবর ফাঁসের প্রতিক্রিয়ায় তাঁর এই উদ্যোগ।
গত তিন দশকে হার্ভের বিকৃত যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন জনপ্রিয় তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি থেকে শুরু করে হাল আমলের অনেক অভিনেত্রী। অ্যালিসার মনে হলো, শুধু অভিনেত্রীরাই নন; এমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া সাধারণ নারীর সংখ্যাও কম নয়। এক বন্ধুর সঙ্গে তাঁর কথা হয়। ওই বন্ধু তাঁকে লেখেন, ‘যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার নারীরা যদি তাঁদের স্ট্যাটাসে মি টু লেখেন, তাহলে আমরা এই সমস্যার প্রকটতা সম্পর্কে মানুষকে একটা ধারণা দিতে পারব।’ বন্ধুর এই বার্তা হুবহু তুলে দিয়ে ১৫ অক্টোবর রাতে তিনি টুইট করেন, ‘যারা যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁরা MeToo লিখে টুইটের রিপ্লাই দিন।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটি ছড়িয়ে পড়ল।
তারকা থেকে সাধারণ-লাখ লাখ মানুষের সরব অংশগ্রহণ। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ তোলা মনিকা লিউনস্কি হ্যাশট্যাগ মি টু লিখে টুইট করেন। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির আইনপ্রণেতা স্টেলা ক্রিজি বলেন, বিশ্বের লাখ লাখ নারীর মতো তিনিও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে জানান হলিউড অভিনেত্রী ইভান রেচেল উড। অ্যামি ক্রিশ্চেনসেন নামের এক সাধারণ মার্কিন নারী বলেন, পরিবারের এক সদস্য শৈশবে তাঁকে ধর্ষণ করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তাঁকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়।
পর্দা মেনেও রক্ষা মেলেনি আরব বিশ্বের বহু নারীর। তারাও পশ্চিমা নারীর মতোই যৌন হয়রানি আর নিপীড়নের শিকার হয়েছে। হ্যাশট্যাগ মি টুতে শামিল হয়ে মুখ খোলে বাংলাদেশের নারীরাও। কেউ বলে, স্বজন-বন্ধু-পরিচিতের কাছে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। আবার কারও কথায় উঠে আসে, পথে-ঘাটে আপত্তিকর স্পর্শ আর বাজে মন্তব্য শোনার মতো যৌন হয়রানির কথা।
পাশ্চাত্য কিংবা প্রাচ্য, রাজনীতিবিদ কিংবা চাকরিজীবী, ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাহীন, তারকা কিংবা গৃহিণী-এমন কোনো দেশ, এমন কোনো পেশা বোধ হয় নেই যেখানে নারী যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হয়নি। টাইম-এর প্রচ্ছদে যেন সে কথাই বলা হয়েছে। প্রচ্ছদে আছেন অভিনেত্রী অ্যাশলে জুড, সফটওয়্যার প্রকৌশলী সুসান ফোলার, কৃষ্ণাঙ্গ আইনজীবী অ্যাডামা আইও, সংগীতশিল্পী টেলর সুইফট ও মার্কিন অভিবাসী ইসাবেল পাসকুয়া। আরেকজনের হাতের একটি অংশ আছে ছবিতে, যা নাম না জানা সাহসী নারীদের সম্মানে।
অ্যালিসা যখন হ্যাশট্যাগ মি টু টুইট করেন, তখন নারী বা পুরুষের কথা আলাদা করে বলেননি। তাই নারী-পুরুষ সবাইকে বিষয়টি ছুঁয়ে গেছে। আপন করেছে। মনের কথাগুলো অকপটে বলতে সাহায্য করেছে নারী-পুরুষকে। এত দ্রুত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়া আর মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো প্রকাশ্যে চলে আসা বিস্মিত করেছে অ্যালিসাকে। তাঁর ভাষ্য, ‘এমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া মানুষের সংখ্যাটা আমাকে অবাক করেনি। আমি অবাক হয়েছি, কত লাখ লাখ মানুষ লজ্জায়, সংকোচে কিংবা ভয়ে এসব কথা প্রকাশ করতে পারেনি। পাছে যদি তাদের গায়েই খারাপের তকমা লাগে!’
আসলেই তো। সমাজ তো যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের কথা স্বীকারই করতে চায় না। সমাজ শেখায়-যৌন নিপীড়নের কথা বলতে নেই, এগুলো লজ্জার, গোপন রাখতে হয়, যারা বলে তারা খারাপ-দুশ্চরিত্র। কিন্তু না। এটা প্রতিদিনের, প্রতি মুহূর্তের ঘটনা। বিশ্বের এপ্রাপ্ত থেকে ওপ্রান্ত-সবখানের ঘটনা। লজ্জা কিংবা সংকোচ নয়, প্রতিবাদেই মুক্তি। যৌন নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিকে দোষারোপ নয়, বরং অভিযোগের আঙুল উঠুক যৌন নিপীড়কের দিকে। দাঁড় করানো হোক বিচারের কাঠগড়ায়। সবাই যদি আওয়াজ তোলে, যৌন নিপীড়নকারীরা ভয় পাবে, শাস্তি পাবে। পরিবর্তন আসবেই। হ্যাশট্যাগ মি টু তো সেটাই শেখাল!